পাতা:ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ - জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
হৈদরাবাদে।
২০৫

উভয়ের মধ্য দিয়া একপ্রকার চক্রাকার পথে আমরা চলিতে লাগিলাম। মধ্যে-মধ্যে তারা দেখা যাইতেছে। তারাগুলা এত দূরবর্তী বলিয়া পূর্বে আমার কখন মনে হয় নাই। সর্বত্রই প্রচণ্ড মূর্তিসমূহের মধ্যে জড়াজড়ি-ঝপ্‌টাঝাপ্‌টি, দৈত্যদানবের যুদ্ধ ভীষণ মৈথুন, মনুষ্যদেহের ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়াছড়ি। উহাদের মধ্যে কাহারো অন্ত্র বাহির হইয়া পড়িয়াছে, তবু পরস্পরকে জাপটাইয়া ধরিরা আছে। এখানে শিব, শিব, ক্রমাগতই শিব! শিব—যাহার ভূষণ মণ্ডমালা; শিব—যিনি জগৎ সৃষ্টি করিয়া আবার সংহার করিতেছেন; শিব—যিনি দশ দিকেই সমানভাবে সংহার করিতে পারিবেন বলিয়া বহুবাহু হইয়াছেন; শিব—যাহার মুখে মর্মান্তিক প্রচ্ছন্ন উপহাসের কুটিল রেখা; শিব—যিনি পরে বিনাশ করিবেন বলিয়াই এখন নির্দয়রূপে প্রজা উৎপাদন করিতেছেন। শিব-যিনি ধ্বংসাবশেষের উপর, ছিন্নমূল বাহুসমূহের উপর, ছিন্নভিন্ন অস্ত্ররাশির উপর হুঙ্কার ছাড়িয়া তাণ্ডবনৃত্য করিতেছেন; শিব - যিনি কতকগুলি ক্ষুদ্র মৃতবালিকাকে পদদলিত করিয়া উন্মত্ত আনন্দে হাস্য করিতেছেন এবং তাঁহার পদাঘাতে ঐ সব শবমুণ্ড হইতে মস্তিষ্ক উছলিয়া পড়িতেছে। আমাদের ল্যাষ্ঠানের আলো নীচের দিকে বিকীর্ণ হওয়ায়, শুধু নিম্নস্থ ভীষণ দৃশ্যগুলার মধ্যে কোন-কোনটা একএকবার প্রকাশ পাইয়া আবার তখনি অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়া যাইতেছে। স্থানে-স্থানে এইসব মুর্ত্তি ক্ষয় হইয়া গিয়াছে—বহুশতাব্দীর ঘর্ষণ-স্পর্শনে অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। একটা-কিছু দৃষ্টিগোচর হইবামাত্রই অন্ধকার যেন তাহার উপর একটা তুলি বুলাইয়া দেয় এবং তখনি উহা সেই চঞ্চল তমোরাশির মধ্যে কোথায় যেন ছুটিয়া পলায়—শৈলরাশির সহিত মিশিয়া একাকার হইয়া যায়, আর দৃষ্টিগোচর হয় না, কোথায় গিয়া থামিল বুঝা যায় না। তখন এইরূপ মনে হয়, যেন সমস্ত পৰ্বতটা —তার হৃদয়দেশ পর্য্যন্ত—কেবল কতকগুলা অস্পষ্ট ভীষণ আকৃতিতে সমাচ্ছন্ন; সমস্তই যেন বিলাস ও বিনাশের দৃশ্যে পরিপূর্ণ।