পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিলিতি খেলা বলে গণ্য) চালে। প্রত্যেক গৃহস্থের একখানা করে চণ্ডীমণ্ডপ আছে। সকাল থেকে সেখানে আড্‌ডা বসে। তবে সম্পন্ন গৃহস্থের চণ্ডীমণ্ডপে আড্‌ডা জোর বসে থাকে, কারণ সারাদিনে অন্ততঃ আধসের তামাক যোগাবার ক্ষমতা সব গৃহস্থের নেই। গ্রামের মধ্যে চন্দ্র চাটুয্যে ফণি চক্কত্তি ও মহাদেব মুখুয্যের চণ্ডীমণ্ডপই প্রথম শ্রেণীর প্রতিষ্ঠান, রাজারাম রায় যদিও সম্পন্ন গৃহস্থ, তিনি নীলকুঠির কাজে অধিকাংশ সময়েই বাড়ীর বাইরে থাকেন তার চণ্ডীমণ্ডপে আড্ডা বসে না।

 এরা সারাদিন এখানে বসে শুধু গল্প করে ও পাশা দাবা খেলে। জীবনসংগ্রাম এদের অজ্ঞাত, ব্রহ্মোত্তর জমিতে বছরের ধান হয়, প্রজাদের কাছ থেকে কিছু খাজনা মেলে, আম কাঁঠালের বাগান আছে, লাউ কুমড়োর মাচা আছে, আজ মাছ ধরে কিনে গ্রামের জেলেদের কাছে, দু’মাস পরে দাম দেওয়াই বিধি। সুতরাং ভাবনা কিসের? গ্রাম্য কলু ধারে তেল দিয়ে যায় বাখারির গায়ে দাগ কেটে। সেই বাখারির দাগ গুনে মাসকাবারি দাম শোধ হয়। এত সহজ ও সুলভ যেখানে জীবনযাত্রা, সেখানে অবকাশ যাপনের এই সব অলস ধারাই লোক বেছে নিয়েছে। আলস্য ও নৈষ্কর্ম্য থেকে আসে ব্যর্থতা ও পাপ। পল্লীবাংলার জীবনধারার মধ্যে শেওলার দাম আর ঝাঁজি জমে উঠে জলের স্বচ্ছতা নেই, স্রোতে কলকল্লোল নেই, নেই তার নিজের বক্ষপটে অসীম আকাশের উদার প্রতিচ্ছবি।

 ভবানী এসব লক্ষ্য করেছেন অনেকদিন থেকেই। এখানে বিবাহ করার পর থেকেই। তিনি পরিচিত ছিলেন না এমন জীবনের সঙ্গে। জানতেন না বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ের মানুষের জীবনধারাকে। চিরকাল তিনি পাহাড়ে প্রান্তরে জাহ্নবীর স্রোতোবেগের সঙ্গে, পাহাড়ী ঝর্ণার প্রাণচঞ্চল গতিবেগের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের আনন্দে কাল কাটিয়েচেন—পড়ে গিয়েচেন ধরা এখানে এসে বিবাহ করে। বিশেষ করে এই কূপমণ্ডুকদের দলে মিশে।

 এদের জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই, অন্ধকারে আবৃত এদের সারাটা জীবনপথ। তার ওদিকে কি আছে, কখনও দেখার চেষ্টাও করে না।

১৯৯