পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঝোপে বেজি খস খস করচে পথের ধারে।

 জীবনটা ফাঁকা, একদম ফাঁকা। মড়িঘাটার ওই বড় মাঠের মত। কিছু ভালো লাগে না। চাকরি করা চলচে, খাওয়া-দাওয়া চলচে, সব যেন কলের পুতুলের মত। ভালো লাগে না। করতে হয় তাই করা। কি যেন হয়ে গিয়েচে জীবনে।

 সন্ধ্যা হোলো পথেই। পঞ্চমীর কাটা চাঁদ কুমড়োর ফালির মত উঠেচে পশ্চিমের দিকে। কি কড়া তামাক খায় ব্যাটারা। ওই আবার দেয় নাকি মানুষকে খেতে? কাসির ধাক্কা এখানো সামলানো যায় নি।

 দিগন্তের মেখলা-রেখা বন-নীল দূরত্বে বিলীন। অনেকক্ষণ ঘোড় চলেচে। ঘেমে গিয়েচে ঘোড়ার সর্বাঙ্গ। এইবার প্রসন্ন চক্কত্তির চোখে পড়লো দূরে উঁচু সাদা নীলকুঠিটা দীর্ঘ দীর্ঘ ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে। প্রসন্ন আমীনের মনটা ফুলে উঠলো। তার যৌবনের লীলাভূমি, তার কতদিনের আমোদ-প্রমোদ ও আড্ডার জায়গা, কত পয়সা হাত ফেরতা হয়েচে ওই জায়গায়। আজকাল নিশাচরের আড্ডা। লালমোহন পাল ব্যবসায়ী জমিদার, তার হাতে কুঠির মান থাকে?

 প্রসন্ন চক্কত্তির হঠাৎ চমক ভাঙলো। সে রাস্তা ভুল করে এসে পড়েচে কুঠি থেকে কিছুদূরের গোরস্থানটার মধ্যে। দু’পাশে ঘন বন বাগান, বিলিতি কি সব বড় বড় গাছ রবসন্‌ সায়েবের আমলে এনে পোঁতা হয়েছিল, এখন ঘন অন্ধকার জমিয়ে এনেচে গোরস্থানে। ওইটে রবসন্ সায়েবের মেয়ের কবর। পাশে ওইটে ড্যানিয়েল সায়েবের। এ সব সায়েবকে প্রসন্ন চক্কত্তি দেখে নি। নীলকুঠির প্রথম আমলে রবসন্ সায়েব ঐ বড় সাদা কুঠিটা তৈরি করেছিল গল্প শুনেচে সে।

 কি বনজঙ্গল গজিয়েচে কবরখানার মধ্যে। নীলকুঠির জমজমাটের দিনে সায়েবদের হুকুমে এই কবরখানা থেকে সিঁদুর পড়লে তুলে নেওয়া যেতো, আর আজকাল কেই বা দেখচে আর কেই বা যত্ন করচে এ জায়গার?

 ঘোড়াটা হঠাৎ যেন থমকে গেল। প্রসন্ন চক্কত্তি সামনের দিকে তাকালে, ওর সারা গা ডোল দিয়ে উঠলো। মনে ছিল না, এইখানেই আছে শিপ‌্টন‌্ সায়েবের

৩৬৮