পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ইছামতীর বাঁকে বাঁকে বনে বনে নতুন কত লতাপাতার বংশ গজিয়ে উঠলো। বলরাম ভাঙনের ওপরকার সোঁদালি গাছের ছোট চারাগুলো দেখতে দেখতে কয়েক বছরের মধ্যে ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়ে ওঠে, কত অনাবাদী পতিত মাঠে আগে গজালো ঘেঁটুকন, তারপর এল কাকজঙ্ঘা, কুঁচকাঁটা নাটা আর বনমরিচের জঙ্গল, ঝোপে ঝোপে কত নতুন ফুল ফুটলো, যাযাবর বিহঙ্গকূলের মত কি কলকূজন। আমরা দেখেচি জলিধানের ক্ষেতের ওপরে মুক্তপক্ষ বলাকার সাবলীল গতি মেঘপদবীর ওপারে মৃণালসূত্র মুখে। আমরা দেখেছি বনসিমফুলের সুন্দর বেগুনী রং প্রতি বর্ষাশেষে নদীর ধারে ধারে।

 ঐ বর্ষাশেষেই আবার কাশফুল উড়ে উড়ে জল-সরা কাদায় পড়ে বীজ পুঁতে পুঁতে কত কাশঝাড়ের সৃষ্টি করলো বছরে বছরে। কাশবন কালে সরে গিয়ে শেওড়াবন, সোঁদালি গাছ গজালো—তারপরে এল কত কুমূরে লতা, কাটাবাঁশ, বনচালতা। দুললো গুলঞ্চলতা, মটরফলের লতা, ছোট গয়ালে, বড় গোয়ালে। সুবাসভরা বসন্ত মূর্তিমান হয়ে উঠলো কতবার ইছামতীর নির্জন চরের ঘেঁটুফুলের দলে…সেই ফাল্গুন-চৈত্রে আবার কত মহাজনী নৌকা নোঙর করে রেঁধে খেল বনগাছের ছায়ায়, ওরা বড় গাঙ বেয়ে যাবে এই পথে সুন্দরবনে মোমমধু সংগ্রহ করতে, বেনেহার মধু, ফুলপটির মধু, গেঁয়ো, গরান, সুঁদুরি, কেওড়াগাছের নব প্রস্ফুটিত ফুলের মধু। জেলেরা সলা-জাল পাতে গলদা চিংড়ি আর ইটে মাছ ধরতে।

 পাঁচপোতার গ্রামের দু’দিকের ডাঙাতেই নীলচাষ উঠে যাওয়ার ফলে সঙ্গে সঙ্গে বন্যেবুড়ো, পিটুলি, গামার, তিত্তিরাজ গাছের জঙ্গল ঘন হোলো, জেলেরা সেখানে আর ডিঙি বাঁধে না, অসংখ্য নিবিড় লতাপাতার জড়াজড়িতে আর সাঁইবাবলা, শেঁয়াকুল কাঁটাবনের উপদ্রবে ডাঙা দিয়ে এসে জলে নামবার পথ নেই, কবে স্বাতী আর উত্তর-ভাদ্রপদ নক্ষত্রের জল পড়ে ঝিনুকের গর্ভে মুক্তো জন্ম নেবে, তারই দুরাশায় গ্রামান্তরের মুক্তো-ডুবুরির দল জোংড়া আর ঝিনুক

৩৭৩