পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
১০০১

রাখা যায়। এই থলের বিনুনী খুব ঘন আর মজবুত; একটা ডানকোনা মাছও তাহার ফাঁক দিয়া গলিতে পারে না। থলের মুখের দুই পাশ হইতে খুব লম্বা লম্বা দুখানা জাল বাহির হইয়াছে তাহার একধার জলের উপরে ভাসে, আর একধার জলের নীচে ডুবিয়া ঝুলিতে থাকে। এই যে দুপাশের দুখানা জাল, তাহার বুনট থলের মতো এত ঘন নহে;আর থলের মুখ হইতে যতই দূরে যাওয়া যায়, ততই উহার ফোকর বড় হইয়া শেষটা এত বড় হয় যে তাহার ভিতর দিয়া তুমি আমিও ইচ্ছা করিলে গলিতে পারি। এত বড় ফোকরের ভিতর দিয়া মাছ কেন গলিয়া পলায় না, আমি অনেক সময় এ কথা ভাবিয়াছি।

 জালখানিকে রীতিমত সমুদ্রে ফেলা হইলে, প্রায় সিকি মাইল জায়গা ঘেরা হয়। সিকি মাইল দূরে সমুদ্রের ভিতরে থলেটা থাকে। হার মুখের এক পাশ জলের উপরে, এক পাশ জলের নীচে থাকে; যেন সে মাছগুলিকে গিলিবার জন্য হা ঁকরিয়া আছে। এই হা ঁকরা মুখের দুপাশ হইতে দুখানি জালের বেড়া ডাঙ্গা অবধি গিয়াছে মাঝখানে মাছ রহিয়াছে। তাহাদের সমূহই বিপদ, কিন্তু তখনো তাহারা তাহা বুঝিতে পারিতেছে না। যদি পারিত তবে তাহাদের অধিকাংশই অনায়াসে ঐ সকল বড়বড় ফোকরের ভিতর দিয়া গলিয়া বাঁচিতে পারিত। কিন্তু তাহারা তো তখনো সেই সিকি মাইল দূরের সর্বনেশে থলের সংবাদ পায় নাই। তাহারা প্রথমে খালি সেই বড় বড় ফোকরের মধ্য দিয়া পলায়ন করিবার সুযোগ তাহাদের চলিয়া যায়।

 এদিকে জেলেরা ডাঙ্গায় থাকিয়া দুই বেড়ার দুই মাথা একত্র করিয়া জালে টান ফেলিয়াছে। তাহাদের দুজন জলে নামিয়া ক্রমাগত জাল ঠিক রাখিতেছে, যাহাতে ঢেউয়ের তাড়ায় জাল জড়াইয়া গিয়া মাছ পলাইবার সুবিধা না হয়। ইহাদের গোলমালে মাছগুলি একদিকে যেমন জাল হইতে দূরে থাকিতেছে আরেক দিকে তেমনি ডাঙ্গার দিক হইতে থলের দিকে গিয়া জড় হইতেছে। সেদিকে জালের ফোকর ক্রমেই ছোট-ছেট, সুতরাং সে পথে পলাইবার আর ভরসা নাই। তখন ইচ্ছা থাকুক আর না থাকুক, ঐ থলের ভিতরেই তাহাদিগকে ঢুকিতে হয়। ভূতে পশ্যন্তি বর্বরাঃ!’অর্থাৎ যাহারা বোকা, বিপদ হইয়া গেলে পরে তাহাদের চৈতন্য হয়, সারা বছর নিদ্রায় কাটাইয়া পরীক্ষার সময় অনেক ছাত্র-বাবুদের যে দশা হয় সেইরূপ।

 এত পরিশ্রম করিয়া জালে কি উঠে, তাহা জানিতে সকলেরই ইচ্ছা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে ফল বড়ই অনিশ্চিত! এক একদিন থলে এমনি বোঝাই হইয়া উঠে যে সকলে মিলিয়া তাহাকে টানিয়া ডাঙ্গায় আনাই কঠিন হয়। আবার একদিন দেখিলাম যে একটা জালে একক্ষেপে মোটে সাড়ে পাঁচ আনার মাছ উঠিল। যে জেলের জালে ঐরূপ হইয়াছিল সে আমাকে বলিল বাবু, কাল খুব মাছ পাইয়াছিলাম, তিনশো টাকার মাছ বেচিয়াছি।

 জালে জেলী ফিশটা খুবই উঠে। জাল ডাঙ্গায় উঠিবার পূর্বেই এ কথা বলা যায় যে আর কিছু উঠুক না উঠুক, ঝুড়িখানেক জেলী ফিশ উঠিবে। আর একটা বিষয় এই দেখা যায় যে এক একটা জালে এক এক জাতীয় মাছই খুব বেশি পড়ে। খণ্ডবালিয়া উঠিল তো দেখিবে খালি খণ্ডবালিয়াতেই জাল বোেঝাই। কোনোদিন হয়তো দেখিবে থলের প্রায় প্রত্যেক ফোকরেই একটা কাঁকল মাছের ঠোট বাহির হইয়াছে। ইহাতে বুঝা যায় যে এই সকল মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে বেড়ায়, আর জালে পড়িলে ঝাকসুদ্ধই পড়ে। খুব বড় মাছ আমি জালে পড়িতে দেখি নাই।

উপেন্দ্র —১২৬