পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০০২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 সমুদ্রের ধারে বালির উপদ্রব একটু বেশি এ কথা পূর্বেই বলিয়াছি। হাওয়ায় বালি উড়াইয়া সেখানকার টালিবধানো রাস্তাটিকে ক্রমাগতই ডুবাইয়া দেয়; তাই মাঝে মাঝে লোক লাগাইয়া তাহাকে আবার খুঁড়িয়া বাহির করিতে হয়। সেখানকার ছোট গির্জাটির আঙ্গি নায়ও এইরূপ বালির অত্যাচারের চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়।

 পুরীর রেলের স্টেশনের কাছে সমুদ্রের ধারে চক্রতীর্থ নামক একটি স্থান আছে। দুইএকটি মন্দির ভিন্ন সেখানে আর কিছু নাই। যে নিমকাঠ দিয়া জগন্নাথের মূর্তি গড়া হইয়াছে, সেই নিমকাঠ সমুদ্রের জলে ভাসিতে ভাসিতে ঐ চক্রতীর্থে আসিয়া লাগিয়াছিল, তাই উহা তীর্থস্থান হইয়াছে। ওখানকার একটি মন্দিরের দেবতা নুমান। তীর্থযাত্রীরা সেই হনুমানের মন্দির প্রদক্ষিণ করে, আর তাহার পূজা দেয়। লোকের বিশ্বাস এই যে হনুমান ওখানে থাকাতে দেশ সমুদ্রের অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইতেছে নচেৎ মহা মুশকিলই হইত।

 চক্রতীর্থের কাছেই একটা বালির টিপির উপরে আর একটি ছোট মন্দির আছে। চৈতন্যদেব পুরীতে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন। তাঁহার দেহ যে স্থানে আসিয়া তীরে লাগিয়াছিল, ঐ ছোট মন্দিরটি সেইখানে তয়ের করা হইয়াছে। সেখানে গেলে চৈতন্যদেবের খড়ম প্রভৃতি কতকগুলি জিনিস দেখিতে পাওয়া যায়। সমুদ্রের ধারের আর দুইটি বিষয়ের কথা বলিলেই পুরীর পালা শেষ করিতে পারি। পুরীতে মাঝে মাঝে জাহাজ আসে এ কথা বলিয়াছি। সুতরাং পুরী যে একটি জাহাজের স্টেশন এ কথা আর বিশেষ করিয়া না বলিলেও চলে। এখান হইতে বিলাত প্রভৃতি স্থানে যে সকল জাহাজ যায়, তাহারা পুরীর কাছ দিয়া যায় না; তাহাদের পথ পুরী হইতে প্রায় ষাট মাইল দূরে সমুদ্রের ভিতর দিয়া। কিন্তু এমন অনেক জাহাজ আছে যাহার রেঙ্গুন প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত করে। পুরী এইসকল জাহাজের স্টেশন।

 এই সকল স্টেশনে দুইটি বিষয়ের বন্দোবস্ত রাখিতে হয়। ১) একটা নিশান, ২) রাত্রিকালের জন্য একটা আলো। সাধারণ নিশান এবং আলোর সঙ্গে এই নিশান আর আলোর একটু প্রভেদ আছে, তাই ইহাদের কথা এখানে উল্লেখ করিয়াছি।

 নিশানের দ্বারা জাহাজের লোকদিগকে নানারূপ সংবাদ দেওয়া যায়। ছোট-ছোট অনেক রকমের নিশান আছে, তাহাদের প্রত্যেকটির আকার এবং রঙ ভিন্ন রকমের আর প্রত্যেকটির এক একটা বিশেষ অর্থ আছে। এই সকল নিশান আর তাহার অর্থের দস্তুর মতন অভিধান থাকে, তাহার সাহায্যে নিশানের ভাষায় কথাবার্তা চালানো যায়।

 বাস্তবিক এরূপ একটা উপায় না থাকিলে জলযুদ্ধের সময় ভারি মুশকিল হইত। যিনি সেনাপতি, তিনি হয়তো যুদ্ধের সময় ইচ্ছা করিলেন যে নিজের জাহাজগুলিকে কোনো একটা বিশেষ হুকুম দিবেন। এখন সে হুকুম দেওয়া যায় কি করিয়া? স্থলে হইলে হয়তো দূত পাঠাইয়া সংবাদ দেওয়া সম্ভব হইতে পারিত, (স্থলযুদ্ধের জন্যও নানারূপ সংকেতের ব্যবস্থা আছে) কিন্তু নৌযুদ্ধে এরূপ সংবাদ কে লইয়া যাইবে? আর কেহ লইয়া যাইতে পারিলেও হয়তো সংবাদ পৌছইবার পূর্বেই যুদ্ধ শেষ হইয়া যাইবে। এইজন্য নৌযুদ্ধে ঐরূপ নিশানের দরকার। এই সকল জাহাজের লোকেরাই তৎক্ষণাৎ তাহা দেখিতে পায়, আর হুকুম মতো কাজ করে।