পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০১২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

ভিতর ঢুকে তার নাড়ী-নক্ষত্র সব টের পাচ্ছি। আগে ছিলাম বিদেশী, এখন হয়েছি তা দেশের লোক। সে হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, আমাদের ঘরের ভিতরে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যায়। বেড়াতে বেরুলে আমার দাড়ি ভিজিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে রসিকতা করে। হাত ভিজাবে না, নাক মুখ কান কিছু ভিজাবে না, ধুতি ভিজাবে না, তা ভিজাবে না;ওর যত ঝোক আমার ঐ ঝাঁকড়া দাড়িগোঁফগুলোর উপরে আর পশমী কাপড় চোপড়ের উপরেও কতক। এসবের উপরে মুক্তার বিন্দু ছড়ানোই যেন তার কাজ।

 অনেকদিন ভোরের বেলায় উঠে দেখি, পাহাড়ের পিঠের উপরে মেঘের খোকারা ঘুমিয়ে আছে তাদের মাথার উপর দিয়ে হিমালয়ের ঝাপসা ছেয়ে রঙ্গের চূড়াগুলি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তখনো সূর্য উঠে নি, পুবের আকাশে লাজুক হাসির মতো একটু আলো দেখা দিয়েছে মাত্র। ক্রমে হিমালয়ের মুখ রাঙা হয়ে উঠতে লাগল, ব্যস্ত হয়ে রঙ ঢেলে তুলি নিয়ে বসলাম, মনে হল কতই কিছু আঁকব।

 দুষ্টু মেঘের খোকা! রোদের গন্ধ পেয়ে সে বেচারাও তাদের বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে। তারপর এক পা দু পা করে, না জানি কোন দেশের পানে তারা রওয়ানা হল। হিমালয় দিল ঢেকে, আমার আঁকবার আয়োজন সব দিল মাটি করে। দেখতে দেখতে তারা পাহাড় বন বাড়ি ঘর সব গ্রাস করে ফেলল। তখন আর আশপাশের বাড়ি ঘর গাছপালা কিছুই দেখবার জো নেই। আমাদের বাড়িখান যে মজবুত পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, পুষ্পক রথের মতো শুন্যে উড়ে পরীর মুলুকের পানে ছুটে চলছেনা, এ কথাটি বিশ্বাস করা ভার হয়ে উঠল। আবার তার দশ মিনিট পরেই দেখা গেল যে মেঘ উড়ে গিয়ে চারদিক রোদ ঝকমক করছে।

 সারাদিন ভরে এমনিতর খেলা। কখনো গেঁড়ির মতো হামা দিয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠে, কখনো ভেড়ার পালের মতো পাহাড়ের গায়ে বসে দল বেঁধে বিশ্রাম করে, কখনো বিশাল দৈত্যের মতন উঠে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি আড়াল করে ফেলে। ঐ যে ভারী ভারী মেঘগুলো জল ঢেলে আমাদের দেশ ভাসিয়ে দেয়, তাদের এক একটা যে কত উঁচু, তা এখানে এলে বেশ বুঝতে পারা যায়।

 ঐ দেখ সকল পাহাড়ের হাঁটুর নীচে, বাংলাদেশের মাটির কাছে, তার তলা থেকে বৃষ্টির ধারা নামছে, আর তার মাথা দশ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় ছাড়িয়ে আরো প্রায় দশ হাজার ফুট উপরে উঠে গিয়েছে।

 সারাদিন ভরে এমনিতর খেলা। তারপর সন্ধ্যাবেলায় শীত লেগে, আবার হয়তো তাদের ঘুমের কথা মনে হয়;অমনি তারা পাহাড়ের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, না হয় দুই পাহাড়ের মাঝখানের গর্তে নেমে, তাকে পরিপূর্ণ করে, বিশ্রাম করতে থাকে। দেখলে মনে হয়, না জানি কোন ধুনুরী মেঘের তুলো ধুনে রেখে দিয়েছে তা দিয়ে ঘুম পাড়ানী মাসির লেপ তয়ের হবে

 মনে করো না যে রোজই এমনিতর হয়। এর শোভা নিত্য নুতন। কখনো বা মেঘে আর রোদে মিলে পাহাড়ের গায়ে রঙ বেরঙের ঢেউ খেলিয়ে চোখ জুড়িয়ে দেয়, কখনো বা ঘড় ঘড় গর্জনে দিক বিদিক্‌ আঁধার করে, দিনের পর দিন খালি জলই ঢালতে থাকে। বর্ষাকালের আগাগোড়াই প্রায় এমনি ভাব। তখন প্রাণ ঝালাপালা হয়ে যায়, আর এদেশে থাকতে ইচ্ছা