পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০১৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

মাথায় আসে না। আমাদের বাংলার মাঠে এর একটাকে পাওয়া যেত, তবে তার আদর বেশ ভালো করেই হত। এদেশের পরেশনাথ পর্বতখানি ৪৫০০ ফুট মাত্র উঁচু, তাকে দেখেই কত লোকে অবাক হয়ে যায়।

 আর এক কথা এই হচ্ছে যে এ সকল পর্বত যে দার্জিলিঙের খুবই কাছে, তা নয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা সেখান থেকে সোজাসুজি পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে। কিন্তু পাহাড়ের পথ দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে প্রায় দুশো মাইল হাঁটতে হয়। অথচ, সেখানকার হাওয়া যারপরনাই পরিষ্কার বলে তাকে এতই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় যে তাকে এত দূরের জিনিস বলে বোঝাই কঠিন হয়। কাজেই সে আসলে যত বড়, দেখলে মনে হয় যেন তার চেয়ে ঢের ছোট।

 যে হিমালয়ে না গিয়েছে সে বুঝতেই পারবে না সেখানকার হাওয়া কত পরিষ্কার। দশ মাইল দূরের জিনিসটিকে এত স্পষ্ট দেখা যায় যে মনে হয় যেন সে দু তিন মাইল মাত্র দূরে। কুড়ি মাইল, পঁচিশ মাইল দূরে পাহাড়ের উপরে বাড়ি আছে, পরিষ্কার দিনে তাতে রোদ পড়ে ঝক ঝক করতে থাকে। এত দূর থেকে নিতান্তই বিন্দুটির মতো ছোট দেখায়, নইলে তার দরজা জানলা গুণে দেওয়া যেত।

 এই পরিষ্কার বাতাসেই হিমালয়কে এমন ঝকঝকে করে রেখেছে। সেখানকার রোদের একটা জ্যোতি আছে, যা আমাদের এই ধুলোমাখা রোদে নাই। তার উপরে আবার ঝকঝকে বরফ। তার উপরে রোদের খেলা একবার যে দেখেছে সে আর জন্মে তা ভুলতে পারবে না। যদি পারে, সে বড় দুঃখী লোক।

 ভোরে আর সন্ধ্যায় যখন ঘন ঘন রোদের রঙ বদলাতে থাকে, তখন হিমালয়ের চেহারাও পলে পলে নূতন হতে থাকে। এই মিছরির কুঁদোর মতে, এই আগুনের মতে, এই সোনার মতো, এই মুক্তোর মতে, এই গরদের উপর চাঁদির কাজের মতো, এই খড়ির মতো যেন জাদুকরের ভেল্কি। এমনি করে দিনটি কেটে গিয়ে বিকালে আবার সোনার মতো, পাহাড়ের মাথায় সেই মানিকের মতো বরফ, সে যে কি সুন্দর, তার তুলনা কোথাও নাই। রাজরানীর বহুমূল্য পোশাক আর মুকুট তার কাছে লাজে মাথা হেঁট করে।

 এমনি করে রাত্রি এসে উপস্থিত হয়। তখন যদি আকাশে উজ্জ্বল চাদ থাকে, তবে তার শোভা হয় যেন আরো চমৎকার। অবশ্য তাতে তেমন তাক লাগিয়ে দেয় না, কাজেই সকলের কাছে তার তেমন আদর নাও হতে পারে। কিন্তু যে বোঝে, সে দেখেই বলে, আহা!

 লোকে বলেছে ওখানে দেবতাদের বাস। এমন সুন্দর জিনিস দেখে ও কথা বলবে, এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নাই। ও যে কতখানি সুন্দর, এসব কথায় তাই বোঝা যাচ্ছে।

 যা হোক, দূরে থেকে সুন্দর হলেও, ও সকল বড় ভয়ংকর স্থান। হিমালয় পার হয়ে তিববত যেতে হয়, কিন্তু পার হওয়ার মতো নিচু জায়গা ওতে বেশি নাই। যে কয়েকটি জায়গা আছে, তার কোনটাই প্রায় পনেরো যোলো হাজার ফুটের কম উঁচু হবে না। তাতেও আবার শীতকালে যাবার জো নাই, কারণ তখন সেসব জায়গা বরফে ঢাকা থাকে। গ্রীষ্মকালে চমরীর পিঠে চড়ে, ঝড়ের শীতের আর বরফের তাড়ায় নাকাল হয়ে, অনেক কষ্টে সে পথে চলতে হয়।