পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১০৩

 এই স্থানের রাজার নাম গুহ। তিনি রামের বন্ধু। রাম আসিয়াছেন শুনিবামাত্রই গুহ তাড়াতাড়ি অনেক লোকজন আর ভাল ভাল খাবার জিনিস লইয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রামের থাকিবার জন্য সুন্দর বিছানা, ঘোড়ার জন্য ঘাস, কিছুই আনিতে তিনি বাকি রাখেন নাই। তাঁহার ইচ্ছা যে, রামকে তাঁহাদের রাজা করিয়া সেইখানেই রাখেন।

 রাম আদরের সহিত তাঁহার সঙ্গে কোলাকুলি করিয়া বলিলেন, ভাই, তোমার ভালবাসাতেই আমার যার-পর-নাই সুখ হইয়াছে। কিন্তু তোমার জিনিস আমি কি করিয়া লইব?’—আমায় যে তপস্বীর মতন ফল মূল খাইয়া থাকিতে হইবে। আমাদের কিছুই দরকার নাই, কেবল ঘোড়াগুলিকে দুটি ঘাস দিতে বল। কাজেই গুহ রামকে আর পিড়াপিড়ি করিলেন না। রাম সীতা জল মাত্র খাইয়া গাছতলায় শুইয়া রহিলেন।

 রাত্রিতে রাম ঘুমাইলেন, কিন্তু লক্ষ্মণ জাগিয়া পাহারা দিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া গুহ মনের দুঃখে বলিলেন, ‘রাজপুত্র, আমরাই জাগিয়া বন্ধুকে পাহারা দিব, আপনি ঘুমান।’ লক্ষ্মণ বলিলেন, ‘দাদার এই দুঃখের সময় আমি কেমন করিয়া ঘুমাইব? ইহার পরে বাবা আর বেশী দিন বাঁচিবেন না। তখন মা কৌশল্যা আর সুমিত্রাও নিশ্চয়ই মরিয়া যাইবেন।’ লক্ষ্মণের আর গুহের ঘুম হইল না, সমস্ত রাত্রি তহাদের কাঁদিয়াই কাটিল।

 পরদিন সকালে সুমন্ত্রকে বিদায় দিয়া আর গুহের নিকট বিদায় লইয়া রাম লক্ষ্মণ আর সীতা নৌকায় গঙ্গা পার হইলেন। বুড়া সুমন্ত্রের কি আর অযোধ্যায় ফিরিয়া যাইতে পা চলে? রামের সঙ্গে যাইবার জন্য তিনি কতই না মিনতি করিয়াছিলেন। কিন্তু রাম বলিলেন, ‘তুমি যদি অযোধ্যায় ফিরিয়া না যাও, তবে কৈকেয়ী মনে করবেন যে আমি বুঝি বনে যাই নাই। তাহা হইলে বাবাকে তিনি বড়ই কষ্ট দিবেন;তুমি শীঘ্র অযোধ্যায় ফিরিয়া যাও। সুতরাং সুমন্ত্র আর রামের সঙ্গে যাইতে পারলেন না। তিনি একদৃষ্টে রামের দিকে চাহিয়া রহিলেন। যখন আর রামকে দেখিতে পাইলেন না, তখন তাহার চোখ দিয়া ঝর-ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

 গঙ্গা পার হইবার পূর্বেই রাম লক্ষ্মণ বটের আঠায় জটা পাকাইয়া তপস্বী সাজিয়াছিলেন। গঙ্গা নদীর পরপারে বৎসদেশ। সেখানে হরিণ মারিয়া খাইয়া, তাহারা বর্ম পরিয়া ধনুর্বাণ হাতে বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এক রাত্রি তাহদের সেই বনের ভিতরেই কাটিল। তাহার পরদিন সন্ধ্যার সময় তাহারা প্রয়াগে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমের নিকট গঙ্গার সহিত যমুনা আসিয়া মিলিয়াছে।

 রাম লক্ষ্মণ ভরদ্বাজের আশ্রমে আসিলে পর তিনি তাঁহাদিগকে অনেক আদর যত্ন করিলেন। ভরদ্বাজ রামকে তাহার আশ্রমেই রাখিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু সে স্থানের খুব কাছেই লোকজনের বাড়ি ছিল বলিয়া রামের সেখানে থাকিতে তত ভাল লাগিল না। তিনি ভরদ্বাজকে বলিলেন, দয়া করিয়া আমাদিগকে একটি নির্জন ভাল জায়গা দেখাইয়া দিন।’ ভরদ্বাজ বলিলেন, তবে তুমি এখান হইতে দশ ক্রোশ দূরে চিত্রকূট পর্বতে গিয়া বাস কর। চিত্রকূট খুব সুন্দর আর নির্জন স্থান। সেখানে ফল ফুল,নদী ঝরনা, পাখি, হরিণ অনেক আছে। সে স্থানটি তোমাদের বেশ ভাল লাগিবে।’

 তাহার পরদিনই তাহারা ভরদ্বাজকে প্রণাম করিয়া চিত্রকুট যাত্রা করিলেন। পথে যমুনা নদী পার হইতে হয়। নদীর ধারে শুকনা কাঠের অভাব নাই। খসখসের দড়িতে সেই কাঠ