পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১১৯

 এমন সময় তাঁহারা দেখিলেন, মাটিতে রাক্ষসের পায়ের দাগ রহিয়াছে, মাঝে মাঝে সীতারও পায়ের দাগ পাওয়া যায়। একটা ভাঙা রথ আর একটা ধনুক বাণের টুকরাও সেখানে পড়িয়া আছে।

 এ-সকল পায়ের চিহ্ন কাহার? এত বড় পা রাক্ষস ভিন্ন আর কাহার হইবে? নিশ্চয় সীতাকে রাক্ষসে লইয়া গিয়াছে, না হয় মারিয়া খাইয়াছে!

 এইরূপ ভাবিয়া রাম বলিলেন, ‘আমার সীতাকে রাক্ষসে লইয়া গেল, আর দেবতারা বারণ করিলেন না। আজ যদি আমার সীতাকে তাঁহারা না আনিয়া দেন, তবে আমি সকল সৃষ্টি নষ্ট করিব!’ লক্ষ্মণ তখন তাহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, ‘দাদা, রাগ করিও না। চল এখন ভাবিয়া দেখি এ কাজ কে করিয়াছে। সেই দুষ্টকে শাস্তি দিতেই হইবে।”

 লক্ষ্মণের কথায় রাম একটু শান্ত হইলেন। তারপর তাহারা বনের ভিতর খুঁজিতে খুঁজিতে এক স্থানে দেখিতে পাইলেন, জটায়ু রক্তমাখা শরীরে পড়িয়া আছে। তাহা দেখিয়া রাম বলিলেন, ‘এই দুষ্টই সীতাকে খাইয়াছে। এটা পাখি নয়, নিশ্চয় রাক্ষস! ঐ দেখ উহার বুকে রক্ত লাগিয়া রহিয়াছে!’ এই বলিয়া রাম জটায়ুকে মারিতে গেলেন। তখন জটায়ু বলিল, ‘বাবা, রাবণই আমাকে মারিয়া রাখিয়াছে, তুমি আর আমাকে মারিও না। সীতাকে লইয়া যাইতে দেখিয়া আমি তাহার সহিত অনেক যুদ্ধ করিলাম, কিন্তু দুষ্ট আমার পাখা কাটিয়া সীতাকে লইয়া গেল।’

 এই কথা শুনিয়া রাম তীর ধনুক ছুঁড়িয়া ফেলিয়া, জটায়ুকে জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। জটায়ুর তখন মৃত্যুর আর বিলম্ব নাই; কথা কহিতেও কষ্ট হয়। তথাপি সে রামকে শাস্ত করিবার জন্য ব্যস্ত হইল। প্রাণ যায় যায়, তবুও অনেক চেষ্টা করিল যাহাতে তাঁহাকে সীতার খবর দিয়া যাইতে পারে। কিন্তু হায়! বেচারা কথা শেষ করিবার সময় পাইল না। সবে বলিয়াছিল; ‘রাবণ বিশ্বশ্রবার পুত্র, কুবেরের ভাই’, ইহার মধ্যেই তাহার কথা আটকাইয়া গেল।

 রাম তাহাকে ধরিয়া দেখেন, প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। তখন তাঁহার মনে হইতে লাগিল, যেন রাজা দশরথের মতন কোনও একজন গুরুলোকের মৃত্যু হইল। আপনার লোক মরিলে লোকে যেমন করিয়া তাহাকে পোড়ায়, আর তাহার জন্য কাঁদে, জটায়ুকেও সেইরূপ করিয়া পোড়াইয়া রাম তাঁহার জন্য কাঁদিলেন। তারপর দুই ভাই বনে বনে গুহায় গুহায়, সীতাকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

 এমন সময় ভয়ানক শব্দে বন কাঁপিয়া উঠিল। রাম লক্ষ্মণ খড়গ হাতে সেই শব্দের দিকে অনেক দূর গিয়া দেখিলেন, বিষম বিকটাকার একটা রাক্ষস বসিয়া আছে। সে-রকম রাক্ষসের নাম কবন্ধ; তাহার মাথা থাকে না। কী ভয়ঙ্কর জানোয়ার! যেন একটা হাত-পা-ওয়ালা কালো পর্বত! মাথা নাই, তাহার বদলে পেটটাই দাঁত খিচাইয়া হাঁ করিয়া আছে, আর তাহার ভিতর হইতে প্রকাণ্ড একটা জিহ্বা লক্‌লক্‌ করিয়া বাহির হইতেছে! চোখ একটি বৈ নাই, কিন্তু সেই একটা চোখ আগুনের মত উজ্জল। একটা একটা হাত প্রায় দুই ক্রোশ লম্বা! সেই লম্বা হাত দিয়া সে সিংহ, হরিণ, হাতি যাহা পাইতেছে তাহাই ধরিয়া মুখে দিতেছে!

 রাম লক্ষ্মণকে দেখিতে পাইয়া তাঁহাদিগকেও সে ধরিয়া ফেলিল। লক্ষ্মণ ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘দাদা, এইবার বুঝি প্রাণটা যায়।’ কিন্তু রাম তাঁহাকে সাহস দিয়া বলিলেন, ‘ভয় কী? ব্যস্ত হইতেছ কেন?