পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১২৯

 মরিতে বসিয়াছি, তখন ঐ পাখিটা আমাদিগকে খাইলে আমরা যাহা চাই তাহাই তো হইবে, আর বেশী কী।’ তখন অঙ্গদ সম্পাতিকে পাহাড় হইতে নামাইয়া আনিল। তারপর নিজেদের পরিচয় দিয়া রামের বনবাসের কথা, রাবণের সীতাকে লইয়া যাইবার কথা, জটায়ুর মৃত্যুর কথা, সীতাকে খুঁজিবার কথা, এক-এক করিয়া সকলই তাহাকে বলিল।

 অঙ্গদের কথা শুনিয়া সম্পাতি বলিল, “তোমরা যে জটায়ুর কথা বলিতেছ, সে আমার ভাই। তাহাকে যে মারিয়াছে, তাহার শাস্তি দিই এমন শক্তি আমার আর নাই। ছেলেবেলায় আমরা দুই ভাই মিলিয়া ইন্দ্রকে জয় করিয়াছিলাম। ফিরিবার সময় সূর্যের নিকট দিয়া আসিতে গিয়া তাহার তেজে জটায়ু অজ্ঞান হয়ে গেল। তাহাকে ঢাকিতে গিয়া আমিও পাখা পুড়িয়া এখানে পড়িলাম। সেই অবধি আমি এখানে পড়িয়া আছি জটায়ুর কী হইয়াছে আমি জানি না।”

 ইহা শুনিয়া অঙ্গদ বলিল, রাবন কোথায় থাকে তুমি জান কি? সম্পাতি বলিল, একদিন রাবণকে আমি একটি মেয়েকে লইয়া যাইতে দেখিয়াছি। সেই মেয়েটি ‘হা রাম! হা লক্ষ্মণ!” বলিয়া কাদিতেছিলেন। বোধহয় তিনিই সীতা। সামনের এই সমুদ্র একশত যোজন চওড়া; তারপর লঙ্কাদ্বীপ, সেই লঙ্কায় রাবণের বাড়ি। তোমরা এই সমুদ্র পার হইয়া লঙ্কায় যাও। আমি নিশ্চয় বুঝিতেছি তোমরা সেখান হইতে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়া আসিতে পারিবে। বাবণ সীতাকে লইয়া যাইবার সময় আমাব পুত্র সুপাশ্ব তাহার পথ আটকাইয়াছিল, কিন্তু রাবণ মিনতি করাতে ছাড়িয়া দিল। আমার পাখা নাই, আমি আর কী করিতে পারি? আমি কেবল মুখের কথা বলিয়াই রামের উপকার করিব। তোমরা আর বিলম্ব করিও না। যাহা করিলে রামের কাজ হইতে পারে তাহা কর।’

 এই কথা বলিয়া সম্পাতি আবার বলিল, সীতাকে যে রাবণ লইয়া যাইবে, এ কথা নিশাকর নামে এক মুনি আমাকে অনেক দিন আগেই বলিয়াছিলেন। আট হাজার বৎসর আগে এখানে নিশাকর মুনির আশ্রম ছিল;ছেলেবেলায় আমি আর জটায়ু তাঁহাকে প্রণাম করিতে যাইতাম। তিনিও আমাদিগকে বড়ই স্নেহ করিতেন। আমার যখন পাখ পুড়িয়া গেল, তখন তিনি বলিলেন, ‘তুমি দুঃখ করিও না; তোমার আবার পাখা হইবে। তুমি এখান হইতে কোথাও যাইও না। আমি তপস্যা করিয়া জানিয়াছি যে, রাজা দশরথের পুত্র রামের স্ত্রী সীতাকে রাবণ চুরি করিয়া লইয়া যাইবে। সেই সীতাকে খুঁজিবার জন্য রামের দূতেরা এখানে আসিলে, তুমি তাহাদিগকে তাঁহার সন্ধান বলিয়া দিও। তাহা হইলেই তোমার আবার পাখা হইবে।” সেই অবধি আমি তোমাদিগের জন্য অপেক্ষা করিয়া এইখানে বসিয়া আছি। আমার অনেক দুঃখ, কিন্তু রামের এই কাজটি করিবার জন্য আমি সকল দুঃখ ভুলিয়া আছি। সুপার্শ্ব সীতার সাহায্য করে নাই বলিয়া আমি তাহাকে বকিয়াছিলাম।’

 কী আশ্চর্য! এই কথা বলিতে বলিতে সম্পতির সুন্দর লাল রঙের পাখা হইল। তখন সে বানরদিগকে ডাকিয়া বলিল, “দেখ! মুনির বরে আমার আবার পাখা হইয়াছে, আর গায়ে যেন সেই আমার প্রথম বয়সের মতন জোর বোধ হইতেছে! তোমরা চেষ্টা কর, নিশ্চয়ই সীতাব সন্ধান পাইবে। এই বলিয়া সম্পাতি আনন্দে নীল আকাশে উড়িয়া চলিয়া গেল। তাহা দেখিয়া বানরদিগের মনে যে আনন্দ ও আশা হইল, তাহা আর কী বলিব! তখন তাহারা নিশ্চয় বুঝিতে পারিল যে, সীতার খবর পাওয়া যাইবে।