পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 তারপর রামের সৈন্য পর্বত হইতে নামিয়া লঙ্কার দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইল। লঙ্কার কোন দরজা দিয়াই তাহারা রাক্ষসদিগের বাহির হইবার পথ রাখিল না। উত্তর দরজায় রাবণ ছিল, রাম লক্ষ্মণ নিজে গিয়া সেই দরজা আটকাইলেন। মৈন্দ, দ্বিবিদ আর নীল পূর্ব দরজা আটকাইল। ঋষভ, গবাক্ষ, গয় আর গবয়কে লইয়া দক্ষিণ দরজায় রহিল। পশ্চিম দরজায় গাছপাথর লইয়া নিজে হনুমান। উত্তর দরজা আর পশ্চিম দরজার মাঝখানে সুগ্রীব। এইরূপে সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। এখন রাবণ বাইরে আসিলেই হয়।

 তখন রাম অঙ্গদকে রাবণের সভায় পাঠাইয়া দিলেন। রাবণ পাত্রমিত্র লইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় অঙ্গদ সেখানে গিয়া উপস্থিত। সেখানে গিয়া সে রাবণকে বলিল, “আমি শ্রীরামের দূত, আমার নাম অঙ্গদ। আমার পিতার নাম বালী;তাহার কথা বোধহয় তোমার এখনও মনে আছে। রাম বলিলেন তুমি শীঘ্র বাহিরে আসিয়া যুদ্ধ কর। তিনি তোমাকে বধ করিয়া বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করিবেন।

 এখানে একটা হাসির কথা বলি। অঙ্গদ যে রাবণকে তাহার পিতার নাম বলিয়া তাহার কথা বোধহয় তোমার এখনও মনে আছে বলিল, তাহার কারণ কি জান? রাবণ একবার বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গিয়া বড়ই নাকাল হইয়াছিল। রাবণ সকলকে যুদ্ধে হারাইয়া ত্রিভুবন ঘুরিয়া বেড়াইত আর কেহ তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে সাহস করিত না। যুদ্ধ করিবার আর লোক না পাইয়া শেষে সে একদিন বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গেল। বালী তখন সমুদ্রের ধারে চোখ বুজিয়া সন্ধ্যা করিতেছিল। রাবণ মনে করিল, এই বেলা উহাকে জড়াইয়া ধরিয়া জব্দ করি:চোখ বুজিয়া আছে, দেখিতে পাইবে না। এই বলিয়া ত সে পিছন দিক হইতে গিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিল;কিন্তু প্রাণপণে টানাটানি করিয়াও তাহাকে নাড়িতে পারিল না। ততক্ষণে বালী সন্ধ্যা সারিয়া, রাবণ মহাশয়কে পাখিটির মত খপ করিয়া বগলে পুরিয়া বসিয়াছে। বালী পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এই চারি সমুদ্রের ধারে বসিয়া চারিবার সন্ধ্যা করিত। সবে তখন তাহার একবার সন্ধ্যা শেষ হইয়াছিল;সুতরাং সে রাবণকে বগলে করিয়াই আরও তিনবার সন্ধ্যা করিল। এদিকে সেই বগলের চাপে, গরমে ঘামে আর গন্ধে বেচারা চ্যাপ্টা হইয়া, সিদ্ধ হইয়া, দম আটকাইয়া, পেট ঢাক হইয়া নাকালের একশেষ। মরে নাই কেবল ব্রহ্মার বরে। তাই অঙ্গদ এখন বলিল, “বোধহয় মনে আছে।’

 তাহা শুনিয়া রাবণ বলিল, ‘এই মুর্খ এখনই টুকরা টুকরা করিয়া কাট্ ত রে!” এই কথা বলিতে বলিতেই চারিটা রাক্ষস আসিয়া অঙ্গদকে ধরিয়া ফেলিল। অঙ্গদও সেই চারিটা রাক্ষসকে বগলে লইয়া এক লাফে একেবারে ছাদের উপরে। সেখান হইতে রাক্ষসগুলিকে আছড়াইয়া ফেলিয়া আর ছাদখানকে গুড়া করিয়া,আর-এক লাফে সে রামের কাছে আসিয়া হাজির। ইহার পর দুই দলে ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কত রাক্ষস আর কত বানর যে মরিতে লাগিল, তাহার সীমা-সংখ্যা নাই। চারিদিকে মার মার, কাট কাট, ধুপ ধাপ, বড় ঘড়, ঝন ঝন, ঠকাঠক, চটপট ভিন্ন আর কিছুই শোনা যায় না। সমস্ত দিন যুদ্ধ চলিল, রাত্রিতেও তাহার শেষ নাই। যুদ্ধের স্থানে মরা রাক্ষস আর বানরের পাহাড় হইয়া গেল, রক্তের নদী বহিয়া চলিল, তবুও যুদ্ধের বিরাম নাই।

 এক স্থানে পাঁচটা সেনাপতি অসংখ্য রাক্ষস লইয়া বড়ই গর্জন করিতে করিতে রামের