পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

মানুষ হইয়া জন্মিতেই হইবে। সুতরাং আর উপায় না দেখিয়া তাঁহারা গঙ্গাদেবীকে বলিলেন, “মা। পৃথিবীতে যদি জন্মিতেই হয় তবে যে-সে বাপ-মায়ের ছেলে হইয়া যেন আমরা না জন্মাই, এমনি করিয়া দাও। হস্তিনার রাজা প্রতীপের শান্তনু নামক অতিশয় ধার্মিক পুত্র হইবেন আমরা তাঁহারই পুত্র হইব। আর আমাদের মা হইবে তুমি নিজে। আমাদের জন্যে মা তোমাকে মানুষ হইয়া পৃথিবীতে যাইতেই হইতেছে। তোমার সঙ্গে আমাদের এই কথা রহিল যে, আমাদের জন্মের পরেই তুমি আমাদিগকে জলে ফেলিয়া দিবে৷”

 বসুগণের মিনতি দেখিয়া গঙ্গা তাঁহাদের কথায় রাজি হইলেন৷

 পরম ধার্মিক রাজা প্রতীপ গঙ্গার ধারে বসিয়া চক্ষু বুজিয়া ভগবানের চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় গঙ্গাদেবী একটি সুন্দরী কন্যা হইয়া তাঁহার কোলে গিয়ে বসিলেন। প্রতীপ চক্ষু মেলিয়া দেখিয়া দেখিয়া নিতান্ত আশ্চর্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে মা, বৌমার মতন আসিয়া আমার কোলে বসিলে? আমার পুত্র হইলে তোমাকে তাহার সঙ্গে বিবাহ দিব৷”

 গঙ্গা বলিলেন, “আচ্ছা দিবেন। কিন্তু আমার একটি কথা রাখিতে হইবে আমি যখন যাহা করিব, হাজার মন্দ বোধ হইলেও আপনার পুত্র তাহাতে বাধা দিতে পারিবেন না, তাহার জন্য আমাকে তিরস্কার করিতে পারিবেন না৷” রাজা এ কথায় সম্মত হইবামাত্র, গঙ্গা আকাশে মিলাইয়া গেলেন৷

 প্রতীপের পুত্র হইলে, তাঁহার নাম শান্তনু রাখা হইল। শান্তনু দেখিতে যেমন সুন্দর ছিলেন, ধর্মে, বিদ্যায়, স্বভাবে এবং অন্য সকল গুণেও তেমনি। তাহা দেখিয়া প্রতীপ মনে সুখে তাঁহার হাতে রাজ্যের ভার দিয়া, তপস্যা করিবার জন্য বনে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় তাঁহাকে বলিলেন, “বাবা, একটি দেবতার মেয়ে আমার বৌমা হইতে রাজি হইয়াছিলেন। তাঁহার দেখা পাইলে তুমি তাঁহাকে বিবাহ করিবে, আর তাঁহার মন বুঝিয়া সর্বদা চলিতে চেষ্টা করিবে। তাঁহার কোনো কাজে কখনো বাধা দিও না, বা অসন্তুষ্ট হইও না!”

 যুদ্ধের কাজটা রাজাদের খুব ভালো করিয়াই শিখিতে হয়, আর সর্বদা তাহার অভ্যাস রাখিতে হয়। এইজন্য শিকার তাঁহাদের একটা খুব দরকারি কাজের মধ্যে। শান্তনু শিকার করিতে বড়ই ভালোবাসিতেন। একদিন শিকার করিতে করিতে তিনি গঙ্গার ধারে আসিয়া একটি পরমাসুন্দরী কন্যাকে দেখিতে পাইলেন। এমন সুন্দর মানুষ তিনি আর কখনো দেখেন নাই। তাঁহাকে তাঁহার এতই ভালো লাগিল যে, তিনি তাঁহার সঙ্গে কথা না বলিয়া থাকিতে পারিলেন না৷

 শান্তনু বলিলেন, “আপনি কি দেবতা, না দানব, না অপ্সরা, না যক্ষ, না মানুষ? আপনাকে আমার রানী করিতে পারিলে বড়ই সুখী হইব৷”

 সেই মেয়েটি আর কেহ নহে, গঙ্গা। গঙ্গা বলিলেন, “মহারাজ, আমি আপনার রানী হইব, কিন্তু আমার একটা নিয়ম আছে। আমার কোনো কাজে আপনি বাধা দিতে পারিবেন না, বা অসন্তোষ দেখাইতে পারিবেন না। যদি কখনো বাধা দেন, বা অসন্তুষ্ট হন, তবে তখনই আমি চলিয়া যাইব৷”

 শান্তনু এই নিয়মে রাজি হইয়া পরমাসুন্দরী রানী লইয়া ঘরে ফিরিলেন। তারপর তাঁহাদের দিন খুবই সুখে যায়৷