পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
১৭৫

 কিন্তু ইহার মধ্যে একটা ভারি দুঃখের বিষয় হইয়া উঠিল। রাজার দেবকুমারের মতো সুন্দর এক-একটি ছেলে হয়, আর অমনি রানী তাহাকে গঙ্গায় ফেলিয়া দেন। দুঃখে রাজার বুক ফাটিয়া যায়, তবুও কিছু বলিতে সাহস পান না, পাছে রানী বলেন, “আমি চলিলাম!”

 একটি নয়, দুটি নয়, রানী ক্রমে সাতটি ছেলে এইভাবে জন্মের পরই গঙ্গায় ফেলিয়া দিলেন, সাতবার রাজা চুপ করিয়া দুঃখ সহ্য করিলেন। তারপর যখন আর-একটি ছেলে হইল, তখন রানী হাসিতে লাগিলেন। কিন্তু রাজার প্রাণে আর কত সহ্য হইবে? এই একটি ছেলেকে রাখিতে পারিলেও বুঝি তাঁহার প্রাণ একটু শীতল হয়! এই ভাবিয়া তিনি সকল কথা ভুলিয়া গিয়া এবারে রানীকে বাধা দিলেন। বলিলেন, “হায় হায়, এটিকে মারিও না, কেন তুমি এমন নিষ্ঠুর হইলে? এমন পাপ কি করিতে আছে?”

 রানী বলিলেন, “মহারাজ, এই লও তোমার ছেলে। কিন্তু নিয়মের কথা মনে আছে তো? আমি চলিলাম, তোমার মঙ্গল হউক!”

 তখন গঙ্গা তাঁহার নিজের কথা আর আটজন বসুর কথা রাজাকে বুঝাইয়া বলিয়া, আর ছেলেটি তাহাকে দিয়া, আকাশে মিলাইয়া গেলেন।

 সেই ছেলেটির নাম দেবব্রত আর গাঙ্গেয়, এই দুই নাম রাখা হইল। দেবব্রত খুব ছোট থাকিতেই শান্তনু তপস্যা করিতে বনে চলিয়া গেলেন।

 গঙ্গার ধারেই সেই বন। সেখানে অনেক বৎসর ধরিয়া শান্তনু তপস্যা করিলেন, ততদিনে দেবব্রতও বেশ বড় হইয়া উঠিলেন। রূপে, গুণে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে এই পৃথিবীতে দেবব্রতের সমান কেই রহিল না।

 এমন সময়, একদিন দেবব্রত হরিণ শিকারে বাহির হইয়াছে। আর একটা হরিণ তাঁর তীর খাইয়া পলায়ন করাতে, তাহাকে ধরিবার জন্য তিনি ভয়ংকর তীর ছুঁড়িয়া গঙ্গার জল প্রায় শুষিয়া ফেলিয়াছেন।

 সেইখানে শান্তনু থাকেন। হঠাৎ গঙ্গার জল কেন শুকাইয়া গেল, তাহা জানিতে গিয়া, দেবব্রতের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। কিন্তু দেবব্রত তাঁহাকে দেখিতে পাইয়াই অন্য দিকে চলিয়া গেলেন। যাহাই হউক, শান্তনুর বুঝিতে বাকি রহিল না যে, এটি তাঁহারই পুত্র। তাই তিনি গঙ্গাকে স্মরণ করিয়া বলিলেন, “আমার পুত্রকে আবার দেখাও।”

 তখন গঙ্গা দেবব্রতকে শান্তনুর নিকট উপস্থিত করিয়া বলিলেন, “মহারাজ, এই তোমার সেই পুত্র। আমি ইহাকে বড় করিয়াছি। এই কুমার দেবতার অতিশয় প্রিয়পাত্র। বশিষ্ঠের নিকট সকল বেদ আর বৃহস্পতি ও শুক্রের নিকট সকল শাস্ত্র পড়িয়াছে। পরশুরাম ধনুর্বিদ্যা যত জানেন, সব ইহাকে শিখাইয়াছেন। ইহাকে লইয়া তুমি ঘরে ফিরিয়া যাও।”

 এমন সুন্দর পুত্র পাইয়া রাজা মনের সুখে আবার রাজ্যে ফিরিয়া আসিলেন, আর কিছুদিন পরেই তাঁহাকে যুবরাজ করিয়া দিলেন।

 ইহার মধ্যে একদিন শান্তনু বনের ভিতরে বেড়াইতে গিয়া, দেবতার মতো সুন্দরী একটি কন্যা দেখিতে পাইলেন। সেই কন্যার দেহের এমনি অপরূপ সৌরভ যে, সমস্ত বন তাহাতে ভরিয়া গিয়াছে। রাজা আশ্চর্য হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”

 কন্যা বলিল, “আমি জেলের মেয়ে।”

 মেয়েটির নাম সত্যবতী। আসলে সে জেলের মেয়ে নহে, জেলে তাহাকে একটা মাছের