পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

পাঁচটা ছেলেকে বারণাবতে পাঠাইয়া দিন। তারপর আমরা সব হাত করিয়া লইতে পারিলে যেন উহারা ফিরিয়া আসে৷’

 ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, ‘আমারও তো তাহাই মনে হয়। কিন্তু কাজটা কিনা ভালো নয়, তাই ভয় করি, পাছে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ ইহারা চটিয়া মুস্কিল বাধান৷’

 দুর্যোধন বলিলেন, ‘ভীষ্মের কাছে তো আমরা যেমন, পাণ্ডবেরাও তেমনি। অশ্বথামা আমারই পক্ষের লোক, কাজেই তাঁহার বাবা দ্রোণ আর মামা কৃপাচার্যও আমাদের পক্ষেই থাকিবেন। তারপর একা বিদুর আর আমাদের কি করিবেন?’

 এইরকম তাঁহাদের পরামর্শ হয়, আর এদিকে টাকা দিয়া লোকজনকে বশ করিবার চেষ্টাও চলে। তারপর একদিন ধৃতরাষ্ট্রের পরামর্শে তাঁহাদের লোকেরা সভায় বসিয়া বলিতে লাগিল, ‘বারণাবত যে কি চমৎকার জায়গা, কি বলিব। আর সেখানকার শিবের মন্দিরে এই সময়ে বড়ই ধুমধাম, দেশ-বিদেশের লোক পূজা করিতে আসিয়াছে৷’

 এ-সকল কথা শুনিয়া পাণ্ডবদের বারণাবত যাইতে খুব ইচ্ছা হইল। তাহা দেখিয়া ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, ‘বাছাসকল! শুনিতেছি এটা নাকি বড়ই সুন্দর স্থান, পৃথিবীতে এমন স্থান আর নাই। তা তোমাদের ইচ্ছা থাকিলে, তোমরা সপরিবারে একবার সেখানে গিয়া পরম সুখে কিছুদিন বাস কর। তারপর আবার ফিরিয়া আসিও।’

 ধৃতরাষ্ট্রের দুষ্টবুদ্ধি যুধিষ্ঠিরের বুঝিতে বাকি রহিল না। কিন্তু কি করেন, চারি দিকেই ধৃতরাষ্ট্রের লোক, পাণ্ডবদের হইয়া দু কথা বলিবার কেহ নাই। কাজেই তিনি রাজি হইলেন। তারপর তিনি ভীষ্ম, বিদুর দ্রোণ, কৃপ, অশ্বথামা, গান্ধারী আর ব্রাহ্মণ পুরোহিত প্রভৃতি সকলের নিকট গিয়া বিনয়ের সহিত বলিলেন ‘জ্যেঠামহাশয়ের কথায় আমরা বারণাবত চলিলাম, আপনারা আমাদিগকে আশীর্বাদ করুন।’

 তাঁহারা সকলেই বলিলেন, ‘ভালোয় ভালোয় ফিরিয়া আসিও। তোমাদের যেন কোনো অনিষ্ট না হয়।’

 পাণ্ডবদের বারণাবত যাওয়া স্থির হইয়াছে দেখিয়া দুর্যোধনের আর আনন্দের সীমা রহিল না। তিনি গোপনে পুরোচন নামক তাঁহাদের একজন মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পুরোচন, তোমার মতো আর আমাদের বন্ধু কে আছে? এই যে রাজ্য দেখিতেছ, ইহা যে কেবল আমরাই, তাহা নহে—তোমারও। বাবা আজ পাণ্ডবদিগকে বারণাবত পাঠাইতেছেন। তুমি খুব গাড়ি হাঁকাইয়া উহাদের ঢের আগেই সেখানে চলিয়া যাও। সেখানে গিয়া শহরের একপাশে, নির্জন স্থানে, গাছপালার আড়ালে একটি সুন্দর বাড়ি করিবে। গালা, ধূনা, চর্বি, তেল, শণ্, কাঠ এমনি সব জিনিস দিয়া বাড়িটি প্রস্তুত হওয়া চাই, যাহাতে আগুন ছোঁয়াইবামাত্রই তাহা দপ-দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠে। সাবধান! যেন বাড়ি দেখিয়া কেহ টের না পায় যে তাহাতে এমন কোনো জিনিস আছে। তারপর কুন্তীকে তাহার পাঁচ ছেলে সুদ্ধ নিয়া সেই বাড়িতে রাখিবে। দিন কতক খুব আদর দেখাইয়া উহাদের বিশ্বাস জন্মাইয়া নিবে, শেষে একদিন রাত্রিকালে পাণ্ডবেরা নিশ্চিন্তে ঘুমাইবার সময় দরজায় আগুন দিয়া তাহাদিগকে পোড়াইয়া মারিবে। তাহা হইলে লোকে ভাবিবে, হঠাৎ আগুন লাগিয়াছে আমাদের কেহ সন্দেহ করিবে না৷’

 দুষ্ট পুরোচন এ কথায় ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া চলিয়া গেল৷