পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২৩৫

 তাঁহারা প্রথমে মিষ্টকথায় গান্ধর্বদিগকে বুঝাইতে চেষ্টা করেন। গন্ধর্বেরা তাহা না শুনাতে যুদ্ধ আরম্ভ হইল, আর অর্জুনের সহিত খানিক যুদ্ধ করিয়া তাহাদের এমনি দুর্দশা হইল যে, বেচারাদের টিকিবারও সাধ্য নাই, পলাইবারও পথ নাই, মাটি ছাড়িয়া আকাশে উঠিয়াও স্থির হইবার জো নাই। ইহা দেখিয়া তাহাদের রাজা বিষম রাগে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। কিন্তু অর্জুনের কাছে বলিলেন, “অর্জুন! আমি যে তোমার বন্ধু চিত্রসেন৷”

 তখন অর্জুন দেখেন সত্যিই তো, এ যে চিত্রসেন—সেই স্বর্গে যাঁহার নিকট গান বাজনা শিখিয়াছিলেন। অমনি যুদ্ধ ঘড়িয়া দুই বন্ধুতে কোলাকুলি আরম্ভ হইল৷

 তারপর অর্জুন বলিলেন, “একি বন্ধু কৌরবদিগকে কেন বাঁধিয়া আনিলে?”

 চিত্রসেন বলিলেন, “হতভাগারা তোমাদিগকে অপমান করিতে আসিয়াছিল, তাই ইন্দ্রের কথায় ইহাদিগকে বাধিয়া দেওয়া হয়৷”

 অর্জুন বলিলেন, “তাহা হইবে না! দুর্যোধন আমাদের ভাই, যুধিষ্ঠিরের নিতান্ত ইচ্ছা, ইহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়৷”

 চিত্রসেন বলিলেন, “এমন দুষ্টকে কখনই ছাড়া উচিত নহে! চল আমরা গিয়া যুধিষ্ঠিরকে সকল কথা বলি, তারপর তিনি যাহা বলেন, তাহাই হইবে৷”

 যুধিষ্ঠির যে উহাদিগকে ছাড়িয়া দিলেন, তাহা বোধহয় আর না বলিলেও চলে। তাঁহাদের দুষ্টবুদ্ধির কথা শুনিয়া তিনি কেবল বলিলেন, “ভাই আর কখনো এমন সাহস করিও না, এখন সুখে বাড়ি যাও৷”

 হায় রে মহারাজ দুর্যোধন! যে পাণ্ডবদিগকে জব্দ করিবার জন্য এত জাঁকজমকের সহিত আসিলেন, এখন সেই পাণ্ডবদের কৃপায় প্রাণ লইয়া তিনি চোরের মতন ঘরে ফিরিতেছে। আর ঘরে ফিরিবেনই-বা কোন্ মুখে? তাহার চেয়ে বরং মৃত্যুই তাহার ভালো বোধ হইল। সঙ্গের লোকদিগকে তিনি বলিলেন, ‘আমার আর বাঁচিয়া কাজ কি? তোমরা ঘরে যাও, দুঃশাসন রাজা হউক, আমি এইখানেই পড়িয়া মরিব।’

 দুঃশাসন তাঁহার পায়ে ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, কর্ণ আর শকুনি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, ‘সে কি দুর্যোধন, তোমার কিসের লজ্জা? পাণ্ডবেরা তোমার রাজ্যে বাস করে, কাজেই তাহারা তোমার প্রজা, সুতরাং আপদ-বিপদে তোমাকে রক্ষা করা তো তাহাদের কাজ হইল! ইহাতে তাহাদেরই বাহাদুরী কি, আর তোমারই-বা লজ্জার কথা কি?’

 তবুও সহজে দুর্যোধন শান্ত হইতে পারেন নাই। তাঁহাকে বুঝাইতে দুটি দিন লাগিয়াছিল৷

 দুষ্টলোকের সাজা হয়, কিন্তু তাহাতে তাহার শিক্ষা হয় না। দুর্যোধন কোথায় ইহার পর হইতে পাণ্ডবদিগের সহিত ভালো ব্যবহার করিবেন, না তাঁহার হিংসা আরো বাড়িয়া চলিল৷

 ইহার মধ্যে একদিন দুর্বাশা মুনি দশহাজার শিষ্য সমেত হস্তিনায় আসিলেন। এমন বিষম বদরাগী সর্বনেশে মানুষ এই পৃথিবীতে আর জন্মায় নাই। কথায় কথায় তিনি যাহাকে তাহাকে শাপ দিয়া বসেন! রাত দুপুর হউক না কেন, ‘খাইব’ বলিতেই খাবার আনিয়া উপস্থিত করিতে না পারিলে নিশ্চয় শাপ দিয়া ভস্ম করিবেন। আবার তাড়াতাড়ি আনিতে পারিলে হয়তো বলিবেন, ‘খাইব না। সঙ্গে সঙ্গে দুটা গালি দেওয়াও আশ্চর্য নহে৷’

 দুর্যোধন প্রাণপণে এই দুর্বাশা মুনির সেবা করিয়া তাঁহাকে যারপরনাই খুশি করিয়া ফেলিলেন। দুর্বাশা বলিলেন, ‘আমি বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি কি চাহ?’