পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 যুধিষ্ঠির ভীষ্মের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, “তোমরা শীঘ্র আইস। আজ ভীষ্মের সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করিতে হইবে।”

 ইহার পর হইতে শিখণ্ডীকে সম্মুখে করিয়া, পাণ্ডবগণ ভীষ্মের বধের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কৌরবেরাও সকলে মিলিয়া তাহাদিগকে বাধা দিবার কোনোরূপ আয়োজনই করিতে বাকি রাখিলেন না। তখন যে কিরূপ ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিবার শক্তি আমার আর নাই।

 আর ভীষ্মের কথা কি বলিব? আজ মরিতে হইবে, এই তার প্রতিজ্ঞা। যেমন করিয়া মরিলে ক্ষত্রিয় স্বর্গে যায়, সেইরূপ করিয়া মরিতে হইবে। রণস্থলে ধর্মযুদ্ধে শক্ত সংহার করিতে করিতে প্রাণ দেওয়া অপেক্ষা, ক্ষত্রিয়ের আর গৌরবের কথা হইতে পারে না। ভীষ্মের ন্যায় মহাবীর আর মহাপুরুষ আজ সেই গৌরবের সুযোগ পাইয়া, আর তাহা ছড়িতে প্রস্তুত নয়। তাই তিনি আজ মরিবার জন্য যুদ্ধ করিতেছে। ঐ দেখ, পাণ্ডবদের দলের সোমক নামক সৈন্যগণ দেখিতে দেখিতে তাহার বাণে শেষ হইয়া গেল। ঐ শুন, মেঘ গর্জনের ন্যায় তাহার ধনুকের শব্দ অবিরাম শুনা যাইতেছে। কৃষ্ণ, অর্জুন আর শিখণ্ডী ব্যতীত কেহই সে ধনুকের সম্মুখে টিকিতে পারিতেছে না।

 শিখণ্ডী ভীষ্মের বুকে দশ বাণ মারিলেন। ভীষ্ম তাহা গ্রাহ্য করিলেন না। অর্জুন ক্রমাগত তাহাকে বলিতেছে, “মার! মার?” শিখণ্ডী উৎসাহ পাইয়া বাণে বাণে ভীষ্মকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। সেই মহাপুরুষ, সে সকল বাণের দিকে ভুক্ষেপ না করিয়া, একদিকে অর্জুনকে নিবারণ, আর একদিকে পাণ্ডব সৈন্য সংহার করিতে ব্যস্ত।

 এই সময়ে দুঃশাসন একা পাণ্ডবদিগের সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া ভীষ্মকে রক্ষা করিতেছিলেন। তখন তাহার বীরত্ব দেখিয়া কেহই প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারে নাই। অর্জুন ভিন্ন আর কেহই তাহাকে এড়াইয়া যাইতে পারিলেন না।

 শিখণ্ডী ভীষ্মকে বাণ মারিতে এক মুহূর্তও অবহেলা করিতেছে না। ভীষ্ম হাসিতে হাসিতে তাহার সকল বাণ অগ্রাহ্য করিয়া, ক্রমাগত পাণ্ডব সৈন্য বধ করিতেছে। দুর্যোধন প্রভৃতি সকলে প্রাণপণে ভীষ্মের সাহায্যের জন্য ব্যস্ত; কিন্তু অর্জুনের তেজে তাহাদের সকল চেষ্টাই বিফল হইতেছে। অর্জুনের গাণ্ডীব হইতে ভীষণ বাণ বৃষ্টির আর বিরাম নাই, কৌরব সৈন্যদের আর বুঝি কিছু অবশিষ্ট থাকিল না। কৃপ, শল্য, দুঃশাসন, বিকর্ণ, বিংশতি সকলেই পলাইয়া গেলেন। মৃতদেহে রণস্থল ছাইয়া গেল।

 কিন্তু ভীষ্ম একাই যে অদ্ভুত কাজ করিতেছিলেন, অন্যেরা পলাইয়া যাওয়াতে তাহার কিছুমাত্র ক্ষতি হইল না।

 অর্জুনের কাছে পাণ্ডবপক্ষের যে সকল রাজা ছিলেন, ভীষ্ম তাহাদের সকলকেই মারিয়া শেষ করেন। দশ হাজার গজারোহী, সাতজন মহারথ, চৌদ্দ হাজার পদাতি, এক হাজার হাতি, দশ হাজার ঘোড়া, তাহা ছড়া বিরাটের ভাই শতানীক প্রভৃতি হাজার হাজার যোদ্ধা সেদিন তাঁহার হতে মারা যান।

 এমন সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন, তুমি শীঘ্র ভীষ্মকে বারণ কর। উহাকে মারিতে পারলেই জয় হইবে।”

 অমনি অর্জুন বাণে বাণে ভীষ্মকে আচ্ছন্ন করিলেন। ভীষ্ম সে সকল বাণ খণ্ড খণ্ড