পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মাভারত
২৮৯

কাটিয়া ফেলাতেই ধৃষ্টদ্যুম্ন সে যাত্রা বাঁচিয়া গেলেন।

 ইহার পর হইতে সাত্যকির সহিত দ্রোণের ভয়ানক যুদ্ধ চলিল। কিন্তু জয় পরাজয় কাহারো হইল না। শেষে যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, বিরাট প্রভৃতি আসিয়া সাত্যকির সহিত যোগ দিলে, বহুতর কৌরব যোদ্ধাও আসিয়া দ্রোণের সহায় হইলেন।

 এদিকে বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিল;অর্জুন এতক্ষণ কি করিতেছেন? এখনো জয়দ্রথকে পাইতে তাহার অনেক বিলম্ব আছে কিন্তু তাহার চেষ্টার ত্রুটি নাই। তিনি ক্রমাগত বাণাঘাতে কৌ সৈন্য কাটিয়া পথ করিয়া দিতেছে, আর সেই পথে কৃষ্ণ রথ চালাইতেছেন। অর্জুনের বাণ তাহার ধনুক হইতে ছুটিয়া শত্রুর বুকে পড়িতে যে সময় লাগে, তাহার মধ্যে রথ যাইতেছে এক ক্রোশ! সুতরাং ঘোড়াগুলির যে খুবই পরিশ্রম হইবে, তাহা আশ্চর্য কি? কৃষ্ণ দেখিলেন যে, এগুলিকে একটু বিশ্রাম না করাইলে আর কিছুতেই চলিতেছে না।

 অর্জুনের কি আশ্চর্য ক্ষমতাই ছিল। তিনি ঘোড়ার বিশ্রামের জন্য, রথ হইতে নামিয়া সেই মাঠের মধ্যেই বাণের দ্বারা একটা ঘর গাঁথিয়া ফেলিলেন। সেখানে জল ছিল না, তাই একটি সুন্দর সরোববও করিলেন। সে সরোবরে সুমধুর, সুবিমল জল তো ছিলই, তাহার উপর আবার তাহাতে হাঁসও চরিতেছিল, পদ্মফুলও ফুটিয়াছিল।

 শত্রুরা অবশ্য অর্জনের রথ থামিল এবং অর্জুনকে নামিতে দেখিয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে ছাড়ে নাই। কিন্তু অর্জুনের বাণের কাছে তাহারা কি আর করিবে? কৃষ্ণ সেই বাণের ঘরের ভিতবে ঘোড়াগুলির সাজ খুলিয়া, তাহাদিগকে দলিয়া মলিয়া, জল খাওয়াইয়া, আবার তাজা করিয়া লইলেন। ইহার পর হইতে রথ আবার বায়ুবেগে ছুটিয়া চলিল। জয়দ্রথ যাইবেন কোথায়? ঐ তাহাকে দেখা যাইতেছে।

 এমন সময় দুর্যোধন জয়দ্রথকে বাচাইবার জন্য অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন। এবারে তাহার আর সাহসের সীমা নাই:তাহার গায়ে দ্রোণের বাধা সেই কবচ রহিয়াছে। বাস্তবিকই সে কবচের এমনি আশ্চর্য গুণ যে, অর্জুনের বাছা বাছা বাণগুলি ইহা হইতে ঠিকরাইয়া পড়িতে লাগিল। ইহাতে কৃষ্ণ আর অর্জুন বুঝিতে বিলম্ব হইল না। তখন তিনি বলিলেন, “ঐ কবচসুদ্ধই উহাকে হারাইব।”

 কিন্তু কি মুস্কিল’ অর্জুন মন্ত্র পড়িয়া সাংঘাতিক অস্ত্র সকল নিক্ষেপ করেন, আর অশ্বত্থামা অন্যদিক হইতে বাণ মারিয়া, তাহ মধ্য পথেই কাটিয়া ফেলেন; দুর্যোধনও সেই অবসরে অর্জুন এবং কৃষ্ণকে ক্ষত-বিক্ষত করেন। যাহা হউক, ইহার ঔষধ শীঘ্রই পড়িল। দুর্যোধনের সমস্ত শরীর কবচে ঢাকা, কিন্তু হাত দুখানি খালি। সেই দুখানি হাতেই অর্জুন বাণ মারিতে লাগিলেন। আর দুর্যোধন যাইবেন কোথায়? হাতে বাণ লাগাতে তাহার যুদ্ধ করাই অসম্ভব হইয়া উঠিল। সকলে ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে রক্ষা না করিলে, তখনি মহারাজের প্রাণটিও যাইত।

 তারপর জয়দ্রথকে ধরিবার জন্য অর্জুন অতি ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলে কৌরবদের প্রাণ কাঁপিতে লাগিল। অর্জুনের গাণ্ডীবের টঙ্কার ও কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শখের ভীষণ শব্দে কত লোক যে অজ্ঞান হইয়া গেল, তাহার সংখ্যা নাই। তখন ভূরিশ্রবা, শাল্ব, কর্ণ, বৃষসেন, জয়দ্রথ, কৃপ, শল্য, অশ্বথামা এই আটজনে মিলিয়া অর্জুনকে শরজালে আচ্ছন্ন করিলেন। তাহাদের সকল বাণ কাটিয়া সমুচিত প্রতিফল দিতে অর্জুনের কোনো ক্লেশ হইল না।


উপেন্দ্র—৩৭