পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভূমিকা

উপেন্দ্রকিশোর বায়চৌধুরী, বায় পরিবারের বিখ্যাত তিন পুরুষের প্রথম পুরুষ। উপেন্দ্রকিশোর—সুকুমার—সত্যজিৎ এই পরম্পরার পুরোভাগে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। রায় পরিবারকে অবশ্য কেবল ওই তিনজন পুরুষ সম্পূর্ণ অধিকার করে নেই, আছেন আরও অনেক স্বনামধন্য পুরুষেরা, সারদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, সুবিনয়, সুবিমল যেমন আছেন; তেমনই আছেন স্বনামধন্যা নারীরাও—পুণ্যলতা চক্রবর্তী, সুখলতা রাও, লীলা মজুমদার, নলিনী দাশ বা কল্যাণী কার্লেকার। কিন্তু স্রষ্টা হিসেবে এই শোভাযাত্রা যিনি শুরু করেছিলেন। তিনি উপেন্দ্রকিশোর।

সব মিলিয়ে ছোটোদের জন্য যে খানপনেরো লিখেছেন উপেন্দ্রকিশোর। এঁকেছেন অসংখ্য মজাদার ছবি—সে সবের মূল কথাটি তার সময়কার ধর্ম ও সামাজিক পটভূমিকার সঙ্গে যুক্ত শিশুকে জীবন শেখাও। এ শিক্ষা যেন একদিকে যুক্ত থাকে তার দেশের যা কিছু শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তার সঙ্গে, আবার এ শিক্ষা যেন তাকে পৃথিবীর অধুনিকতম জ্ঞানবিজ্ঞানের খবরগুলি থেকেও বঞ্চিত না করে। ফলে তার দুটি পদ্য রামায়ন, একটি পদ্য-মহাভাবত, পুরাণের গল্প, মহাভারতের অবান্তর গল্পগুলিতে আরও প্রচুর পুরাণের গল্প একদিকে যেমন শিশুকে এক সমৃদ্ধ ও বহুবর্ণময় ভারতীয় ঐতিহ্যের সন্ধান দিয়েছে, তেমনই তাকে প্রচ্ছন্নভাবে শিখিয়েছে ভালো আর মন্দ, ন্যায় আর অন্যায় সংগত আর অসংগতের তফাত শিখিয়েছে মানুষের সত্যকার মহিমা বীরত্বে, দু:খসহনে দানে, ত্যাগে ও অহংকার বিসর্জনে। আবার ‘টুনটুনির বই’ যে মনোহর সব লোককথার সংকলন করে শিখিয়েছেন কেমন করে বুদ্ধিব সাহায্যে দুর্বল সে-ও অত্যাচারী সবলের উপরে জিতে যেতে পরে এভাবেই টুনটুনি জিতে যায় শিয়ালের সঙ্গে, শেয়াল জিতে যায় বাঘের সঙ্গে বা দুর্বল মানুষের বুদ্ধিন কছে বঘ হ'ব লনতে বার হয়। একদিকে কুমিকের সাহায্যে মনুষ্যত্ব শিক্ষা অন্যদিকে লোককাহিনীর সাহয়ে অস্তিত্ববন্ধন কলাকৌশল শিরো অবন্তটি শিক্ষাই এসেছে আনন্দময় গল্পবিববণেত্ব সূত্রে, শিশুকে কখনোই এটা করবে সেটা করবে না বলে স্পষ্ট উপদেশ দেননি উপেন্দ্রকিশোর। এখানে পৌঁছে বুঝতে পারি বিদ্যাসাগরের সময়কার কঠোর ও প্রকাশ নীতিশিক্ষার লক্ষ্য আর জনপ্রিয় নই—‘সদা সত্য কথা বলিবে’ ‘না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়’ ইত্যাদি স্বরক্ষেপের আর তত প্রয়োজন বোধ করছেন না উপেন্দ্রনাথ।

সেই সঙ্গে সঙ্গেই উপেন্দ্রকিশোর ‘সেকালের কথা’ আর ‘বিবিধ প্রবন্ধ’-তে বিজ্ঞানজগতের বহু খবর বিশেষ করে আদিম প্রাণীকুলের নানা চিত্তাকর্ষক সংবাদ দিয়েছে। তাতে নীতিশিক্ষার বিশেষ কোনো প্রকট উদ্দেশ্য নেই আছে জ্ঞানশিক্ষাব লক্ষ॥

অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের সময়ের শিক্ষাচিন্তার পটভূমিকা থেকে উপেন্দ্রকিশোবের সময়কার শিক্ষাচিন্তা পরিবর্তিত হয়েছে। লেখকরা তাদেব সৃজনশীল কল্পনাকে শিশুর আনন্দময়, অবকাশ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়েছেন। উপেন্দ্রকিশোরে শুরু, তারপরেই সুকুমার তার বেহিসেবি উদ্দাম খেয়ালি সৃষ্টির রাজ্যে শিশুকে ডাক দেবেন সেখানে নীতিমূলক কোনো উদ্দেশ্যের বালাই থাকবে না। এখন লেখকদের মনে এই আত্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে গিয়েছে যে, সমাজ দেখবে শিশুর চরিত্র গঠনের বিষয়টি, শিক্ষাব্যবস্থা ও নানা পাঠ্য তাকে মানবিক আচরণবিধি শেখাবে। সাহিত্য সে পড়বে আনন্দের জন্য, কল্পনার বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চারের জন্য, অবশ্যই জ্ঞানের জন্য।

বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড উপেন্দ্রকিশোরের সমগ্র রচনাবলী প্রকাশ করছেন। কাজটির মূল্য এখানেই যে, উপেন্দ্রকিশোরের ক্ষেত্রে যথেষ্টও কখনও যথেষ্ট নয়। তার উপাদেয় ও স্বাস্থ্যপ্রদ রচনাগুলি যত বেশি বাঙালি শিশুদের হাতে পৌঁছবে ততই ভালো। প্রকাশকদের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হলে শিশু পাঠকদেরই উপকার হবে। হয়তো কিছুদিন পবে রবীন্দ্রনাথের রচনার ক্ষেত্রেও এই ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করব।

বাঙালির ঘরে ঘরে উপেন্দ্রকিশোর পৌঁছে যান, অক্ষয় হয়ে থাকুন। পাঠ্য বইয়ের বোঝায় ভারাক্রান্ত শিশুদের মুখে তিনি হাসি ফোটাতে থাকুন।

পবিত্র সরকার