দাবানলভীত জন্তুর ন্যায় চ্যাঁচাইতে লাগিল। সেই চিৎকার শুনিয়া অর্জুন কৃষ্ণকে বলিলেন, “ঐ দেখুন, ভার্গবাস্ত্রে সৈনাগণের কি দুর্দশা হইতেছে। শীঘ্র কর্ণের নিকট রথ লইয়া চলুন।”
কিন্তু কৃষ্ণ ভাবিলেন যে, কর্ণ আরো খানিক যুদ্ধ করিয়া ক্লান্ত হইলে, অর্জুন সহজেই তাহাকে বধ করিতে পারিবেন, কাজেই তিনি কর্ণের দিকে না গিয়া অর্জুনকে বলিলেন, “মহারাজ যুধিষ্ঠির কর্ণের বাণে বড়ই কাতর হইয়াছে। আগে তাহাকে শান্ত করিয়া, তারপর কর্ণকে মারা যাইবে।”
তখন তাহারা তাড়াতাড়ি শিবিরের দিকে আসিতেছেন, এমন সময় অশ্বত্থামা আসিয়া মহারোষে অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন। যাহা হউক, অশ্বত্থামাকে পরাজয় করিতে অনেক সময় লাগিল না। তারপর ভীমের হাতে কৌরবদিগের নিবারণের ভার দিয়া তাহারা যুধিষ্ঠিরকে দেখিতে গেলেন।
সেখানে অনেক কথাবার্তার পর তথা হইতে চলিয়া আসিবার সময় অর্জুন এই প্রতিজ্ঞা করলেন, “আজ হয় আমি কর্ণকে মারিব, না হয় কর্ণ আমাকে মারিবে।”
এদিকে ভীম সেই অবধি আর এক মুহুর্তের জন্যও যুদ্ধে ক্ষান্ত হয় নাই। আজকার যুদ্ধে তাহার বড়ই আনন্দ বোধ হইতেছে। তিনি সারথি বিশোককে ডাকিয়া বলিলেন, “বিশোক, আমার বড়ই উৎসাহ হইতেছে, এখন আর কোন রথটা স্বপক্ষের কোনটা বিপক্ষের তাহা বুঝিতে পারিতেছিনা। একটু সতর্ক থাকিও, যেন শক্র বোধে মিত্রকে মারিয়া না বসি। আজ প্রাণ ভরিয়া শত্রু মারিব। দেখ তো, অস্ত্রশস্ত্র কি পরিমাণ আছে।”
বিশোক বলিল, “এখনো দশ হাজার শর, দশ হাজার ক্ষুর, দশ হাজার ভল্প, দু হাজার নারাচ, তিন হাজার প্রদর, আর অসংখ্য গদা, অসি, মুদগর, শক্তি আর তোমর রহিয়াছে। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধ করুন, অস্ত্র ফুরাইবার কোনো ভয় নাই।”
এই সময়ে অর্জুন কৌরব সৈন্য ছারখার করিয়া, অতি ভয়ংকর যুদ্ধ করিতেছিলেন। সেই যুদ্ধের ঘোরতর শব্দ ভীমের নিকট আসিয়া পৌছিলে, তিনিও যারপরনাই উৎসাহ পাইয়া সিংহাদ করিতে করিতে কৌরবদিগকে একেবারে পিষিয়া দিতে লাগিলেন। তখন আর কেহই তাহার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারিল না।
অন্যদিকে কর্ণও পাণ্ডব সৈন্যদিগকে মারিয়া আর কিছু রাখেন নাই। তাহারা তখন ভয়ে এমনি হইয়াছে যে, আর যুদ্ধ করিবার জন্য তাদের হাত উঠে না।
বাস্তবিক তখন দুই পক্ষের কত লোক যে মরিয়াছিল, তাহার সংখ্যা করে কাহার সাধ্য? দুই পক্ষের প্রায় প্রত্যেক বড় বড় বীরই সে সময়ে হাজার হাজার সৈন্য বিনাশ করিয়াছিলেন।
ইহার মধ্যে একবার দুঃশাসন ভীমকে আক্রমণ করেন। ইহাতে প্রথমেই ভীমের বাণে তাহার ধনুক আর ধবজ কাটা যায়, নিজের কপালেও একটি বাণ বিধে, তারপর এক বাণ আসিয়া তাহার মাথা কাটিয়া ফেলে। তখন দুঃশাসন তাড়াতাড়ি অন্য ধনুক লইয়া ভীমকে বারোটি বাণ মারেন, এবং নিজ হাতে ঘোড়ার রাশ ধরিয়া এক ভীষণ বাণে তাহাকে অজ্ঞান করিতেও ছাড়েন নাই। ইহার উপর আবার তিনি এক বাণে ভীমের ধনুক কাটিয়া তাহার সারথিকে নয়টি, এবং তাহাকে বহুতর বাণ মারাতে, ভীম রাগের ভরে তাহাকে একটা শক্তি ছুঁড়িয়া মারেন।
দুঃশাসন আকর্ণ (কান অবধি, অর্থাৎ যথাসাধ্য) ধনুক টানিয়া দশ বাণে সেই জ্বলন্ত