পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩১২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

দিয়া বিধিমতে যুদ্ধবিদ্যা শিখাইলেন। তারপর একদিন দেখেন কি যে এ-ব্রাহ্মণ নয়, ক্ষত্রিয়! কাজেই তখন তিনি শাপ দিলেন, “মৃত্যুকালে তুই এ সকল ভুলিয়া যাইবি৷”

 তারপর আর একবার দৈবাৎ এক ব্রাহ্মণের বাছুর মারিয়া ফেলাতে সেই ব্রাহ্মণ তাহাকে শাপ দেন, “যুদ্ধের কালে যখন তোর বড়ই আতঙ্ক হইবে, ঠিক সেই সময় তোর রথের চাকা বসিয়া যাইবে৷”

 সেই সকল পুরাতন পাপের শাস্তি আজ আসিয়া একসঙ্গে উপস্থিত হইল। আহা! ঐ দেখ, তিনি হাত ছুঁড়িয়া আক্ষেপ করিতেছেন। কিন্তু বীরের তেজ না কি বিপদেও লোপ পায় না, তাই এখনো তিনি অর্জুনের সহিত ঘোর যুদ্ধে মত্ত! ইহার মধ্যেও কৃষ্ণের হাতে তিন, আর অর্জুনকে সাত বাণ মারিতে ছাড়েন নাই। তাহাতে অর্জুনের বাণ খাইয়া মন্ত্রপূর্বক ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়িয়াছেন। তাহাতে অর্জুন ঐন্দ্রাস্ত্র মারিলে, তাহাও আটকাইয়াছেন। তারপর আবার অর্জুনের ব্রহ্মাস্ত্র প্রভৃতি অশেষ বাণে জর্জরিত হইয়াও না জানি কিরূপে কর্ণ তাঁহার ধনুকের গুণ কাটিলেন: অর্জুন তৎক্ষণাৎ নূতন গুণ পরাইয়াও তাঁহাকে আঁটিতে না পারায় কৃষ্ণ তাঁহাকে আরো বড়-বড় অস্ত্র মারিতে বলিতেছে।

 হঠাৎ কর্ণের রথের চাকা আরো অনেক বসিয়া গেল! বেচারা, তাহা উঠাইবার জন্য, প্রাণপণে কি টানাটানিই করিতেছেন! পৃথিবী তাহাতে চারি আঙ্গুল উঁচু হইয়া গেল, কিন্তু চাকা যে কিছুতেই উঠিতেছে না। এইবারে কর্ণের চোখে জল আসিল; তিনি অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন! তুমি বড়ই ধার্মিক, আর মহাশয় লোক একটু অপেক্ষা কর, আমার রথের চাকাটা তুলিয়া লই।”

 তাহার উত্তরে কৃষ্ণ বলিলেন, “সূতপুত্র! বড় ভাগ্য যে এখন তোমার ধর্মের কথা মনে হইয়াছে! কিন্তু যখন ভীমকে বিষ খাওয়াইবার পরামর্শ দিয়াছিলে, দ্রৌপদীকে সভায় আনিয়া অপমান করিয়াছিলে, ছলপূর্বক যুধিষ্ঠিরকে পাশায় হারাইয়াছিলে, জতুগৃহে পাণ্ডবদিগকে পোড়াইতে গিয়াছিলে, আর সকলে মিলিয়া বালক অভিমন্যুকে বধ করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল?

 এ কথার আর কি উত্তর দিবেন? তাই লজ্জায় কর্ণের মাথা হেঁট হইল। বিষমরোষে ব্রাহ্ম, আগ্নেয়, ব্যায়ব্যাদি অস্ত্র বর্ষণপূর্বক তিনি আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন, এবং অচিরে ভীষণ একটা অস্ত্রে অর্জুনকে অজ্ঞান করিয়া ব্যস্তভাবে রথ হইতে নামিলেন, যদি এই অবসরে তাহার চাকা আবার উঠানো যায়। কিন্তু হায়! চাকা কিছুতেই উঠিল না।

 কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “এই বেলা কর্ণকে মার। উহাকে রথে উঠিতে দিও না।” সে কথায় অর্জুন অঞ্জলীক নামক ভীষণ অস্ত্র গাণ্ডীবে জুড়িবামাত্র ভয়ে সকলের প্রাণ উড়িয়া গেল; আর দেখিতে দেখিতে সেই মহাস্ত্র ঘোর গর্জনে প্রচণ্ড তেজে ছুটিয়া গিয়া কর্ণের মাথা কাটিয়া ফেলিল। তখন সকলে অবাক হইয়া দেখিলেন, কর্ণের দেহ হইতে অপরূপ দীপ্তি নির্গত হইয়া সূর্যের সহিত মিলাইয়া যাইতেছে।

 আজ আর পাণ্ডবদের আনন্দের সীমা নাই। ভীম সিংহনাদপূর্বক নৃত্য করিতেছে; আর সকলে শঙ্খ বাজাইয়া জয় ঘোষণায় মত্ত। বেচারা কৌরবগণ ভয়ে বিহ্বল হইয়া, পলায়নের পথও পাইতেছে না। এমন সময় সন্ধ্যা আসিয়া পড়িল দুর্যোধন, ‘হা কর্ণ! হা কর্ণ!’ বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবিরে চলিলেন।