পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 যাহা হউক, অনেক কষ্টে শেষে তিনি কতক স্থির হইলেন, আর পাণ্ডবদের উপরও তাঁহার রাগ অনেকটা কমিল। ব্যাস তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, “তোমার পুত্রেরা নিতান্তই দুরাচার ছিল। তাহাদের দোষেই এই সর্বনাশ হইয়াছে পাণ্ডবদের ইহাতে কিছুমাত্র অপরাধ নাই।”

 তারপর শ্রাদ্ধের সময় উপস্থিত হইলে, সঞ্জয় আর বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝাইয়া বলিলেন, “মহারাজ এখন শ্রাদ্ধাদির সময় উপস্থিত। শোকের মোহে সে সকল কার্যে অবহেলা করিবেন না।”

 তখন ধৃতরাষ্ট্র, পরিবারের স্ত্রী-পুরুষ সকলকে লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করিলেন। কুলবধুগণ বিধবার বেশে পথে বাহির হইলে পৃথিবীসুদ্ধ লোক তাঁহাদের দুঃখে কাদিয়া আকুল হইল।

 এদিকে পাণ্ডবেরাও কৃষ্ণ, সাত্যকি আর দ্রৌপদী প্রভৃতিকে লইয়া কুরুক্ষেত্রের দিকে আসিতেছিলেন। কিছুদূর আসিয়া ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির সহিত তাহাদের দেখা হইবামাত্র কৌরব নারীগণের দুঃখ যেন দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল, কেননা পাণ্ডবেরাই এই দুঃখের কারণ।

 পাণ্ডবেরা একে একে ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে যাইয়া নিজ নিজ নাম বলিয়া তাহাকে প্রণাম করিতে লাগিলেন। ধৃতরাষ্ট্র বিরক্তভাবে যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন ও তাঁহার সহিত দু একটি কথা কহিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভীম কোথায়?” তখন তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়াই বুঝা গিয়াছিল যে, ভীমকে পাইলে তিনি তাঁহাকে বধ না করিয়া ছাড়িবেন না। তাঁহার এরূপ অভিসন্ধির কথা কৃষ্ণ পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাহার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিতেও ভুলেন নাই। সুতরাং ধৃতরাষ্ট্র ভীমের কথা জিজ্ঞাসা করামাত্র, তিনি একটা লোহার ভীম আনিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। সেই লোহার মুর্ত্তিটাকে আলিঙ্গন করিবার ছলে, ধৃতরাষ্ট্র তাহাকে এমনি চাপিয়া দিলেন যে, তাহা একেবারে চূর্ণ হইয়া গেল! ধৃতরাষ্ট্রের দেহে লক্ষ হাতির জোর ছিল, সুতরাং তিনি যে লোহার ভীম চূর্ণ করিবেন, তাহা আশ্চর্য নহে। আসল ভীমকে পাইলে না জানি তিনি তাহার কি দশা করিতেন।

 যাহা হউক লোহার ভীম চূর্ণ করা লক্ষ হাতির জোরের পক্ষেও সহজ কথা নহে; সুতরাং ধৃতরাষ্ট্র সে কাজ শেষ করিয়াই রক্ত বমি করিতে করিতে পড়িয়া গেলেন। এদিকে ভীমের যথেষ্ট সাজা হইয়াছে মনে করিয়া, তাঁহার রাগ চলিয়া গেল, তখন আবার তিনি “হা ভীম! হা ভীম!” করিয়া কাঁদিতে ত্রুটি করিলেন না। তাহাতে কৃষ্ণ তাঁহাকে বলিলেন, “মহারাজ! দুঃখ করিবার কোনো প্রয়োজন নাই। ওটা লোহার ভীম, যথার্থ ভীম নহে। ভীমকে বধ করিতে যাওয়া আপনার উচিত হয় নাই। দেখুন, যুদ্ধ বারণ করিতে অশেষ চেষ্টা হইয়াছিল, তথাপি আপনার পুত্রেরা তাহাতে ক্ষান্ত হন নাই; তাহারা ফলেই এখন তাঁহাদের মৃত্যু ঘটিয়াছে। সুতরাং ভীমকে তাহার জন্য দোষী করেন কেন?”

 কৃষ্ণের কথায় ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “কৃষ্ণ! তোমার কথাই সত্য। শোকে বুদ্ধিনাশ হওয়াতেই আমি ঐরূপ করিয়াছিলাম।” এই বলিয়া ধৃতরাষ্ট্র ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেবকে আলিঙ্গনপূর্বক আশীর্বাদ করিলেন।

 ধৃতরাষ্ট্র অপেক্ষা গান্ধারীর কথা ভাবিয়াই পাণ্ডবদের মনে অধিক ভয় হইয়াছিল। গান্ধারী সামান্য স্ত্রীলোক ছিলেন না। জীবনে তিনি কখনো একটি অধর্মের কাজ করেন নাইবা একটি