আর ভোজনের বিষয় কি বলিব? অন্নের পর্বত, ধৃত-দধির নদী, আর মিঠাই-মোণ্ডা কি পরিমাণ, তাহা বলিতে পারি না। হাজার হাজার লোক মণি, কুণ্ডল, আর সুবর্ণ মাল্যে সুসজ্জিত হইয়া সেই-সকল সুমধুর খাদ্য পরিবেশন করিয়াছিল। এক-একলক্ষ ব্রাহ্মণের ভোজন শেষ হইলে, এক-একবার দুন্দুভি বাজিত। এইরূপে যজ্ঞের কয়েকদিনের মধ্যে কত শত বার যে দুন্দুভি বাজিয়াছিল, তাহার সংখ্যা নাই।
এইরূপ সমারোহে সেই মহাযজ্ঞ শেষ হইল। এই যজ্ঞে একটি অদ্ভুত ঘটনা হয়। যজ্ঞ শেষে সকলেই যুধিষ্ঠিরের অতিশয় সুখ্যাতি করিতেছেন, এমন সময় একটি আশ্চর্য নকুল আসিয়া তথায় উপস্থিত হইল। উহার চক্ষু দুটি নীল; মাথা আর শরীরের এক পাশ সোনার। নেউল আসিয়া ঠিক মানুষের মতো বলিতে লাগিল, “হে রাজামহাশয়গণ! উঞ্ছবৃত্তি নামক ব্রাহ্মণ যে ছাতু দান করিয়াছিলেন, সে কাজ আপনাদের যজ্ঞের চেয়ে অনেক বড়!”
এ কথায় সকলে আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এমন কি দেখিয়াছ বা শুনিয়াছ যে, এই যজ্ঞকে তাহা অপেক্ষা কম মনে করিলে?”
তাহাতে নেউল বলিল, “আপনারা মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করুন। উঞ্ছবৃত্তি নামক এক ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাঁহার স্ত্রী, এক পুত্র ও পুত্রবধু ছিল। ক্ষেত্রের শস্য কাটিয়া নিলে যাহা পড়িয়া থাকে, উঞ্ছবৃওি এবং তাঁহার পরিবার সেই শস্যমাত্র আহার করিতেন; এইরূপে তাঁহাদের দিন যাইত।
“তারপর দেশে দুর্ভিক্ষ আসিল, ক্ষেত্রে শস্য নষ্ট হইল, ব্রাহ্মণের কষ্টও বৃদ্ধি পাইল। তখন কোনোদিন অতি কষ্টে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ আহার জুটিত, কোনোদিন একেবারেই জুটিত না।
“এই সময়ে একবার সারাদিন ঘুরিয়া, শেষবেলায় ব্রাহ্মণ কিঞ্চিৎ যব পাইলেন। তাহাতে তাহার পরিবারের লোকেরা আহ্লাদিত হইয়া, সেই যবের ছাতু প্রস্তুত করিল। তারপর সকলে স্নান, আহ্নিক অন্তে সেই ছাতু আহারের আয়োজন করিলেন।
“এমন সময় সেখানে এক অতিথি ব্রাহ্মণ ক্ষুধায় কাতর হইয়া উপস্থিত। ব্রাহ্মণ সেই অতিথিকে আদরের সহিত তাঁহার নিজের ছাতুর ভাগ আহার করিতে দিলেন, কিন্তু অতিথির তাহাতে তৃপ্তি হইল না।
“তাহা দেখিয়া ব্রাহ্মণী তাঁহার নিজের ভাগ অতিথিকে দিলেন, কিন্তু তাহাতেও তাহার তৃপ্তি হইল না।
“তাহা দেখিয়া ব্রাহ্মণের পুত্র তাঁহার নিজের ভাগ অতিথিকে দিলেন, কিন্তু তথাপি তাঁহার তৃপ্তি হইল না।
“তখন ব্রাহ্মণের পুত্রবধূ তাঁহার নিজের ভাগ আনিয়া অতিথিকে দিলেন।
“ইহাতে সেই অতিথি পরম পরিতুষ্ট হইয়া বলিলেন, “হে ধার্মিক! ঐ দেখ স্বর্গ হইতে পুষ্পবৃষ্টি হইতেছে দেবতারা তোমার স্তব করিতেছে। এখন তুমি পরম সুখে সপরিবারে স্বর্গে চলিয়া যাও।”
সেই অতিথি ছিলেন, স্বয়ং ধর্ম। তাঁহার কথায় ব্রাহ্মণ স্ত্রী, পুত্র এবং পুত্রবধূ সহ তখনি স্বর্গে চলিয়া গেলেন। তারপর আমি গর্ত হইতে উঠিয়া, সেই অতিথির পাতের উপর গড়াগড়ি দিতে লাগিলাম। তাহাতেই এই দেখুন! আমার অর্ধেক শরীর স্বর্ণময় হইয়া গিয়াছে।