পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৩৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৩৮৫

‘ঝিঙের বীচি।’ এক হাত লম্বা মানুষটি বলিল, ‘আচ্ছ, তাই হোক।’

 রাজবাড়ির দরোয়ানেরা প্রথমে গোষ্ঠকে ঢুকিতে দেয় নাই। তাহারা বলিল, ‘তোরই মতন একটা সেদিন এসে রাজামশাইয়ের পাগড়ি নোংরা করে দিয়ে গেছে। তুই আবার একটা কি করে বসবি কে জানে!’ অনেক পীড়াপীড়ির পর গোষ্ঠ ঢুকিয়া রাজার মেয়েকে কিরূপ লেবু খাওয়াইল, বুঝিতে পার। সাজাটাও তার তেমনিই হইল।

 মানিককে সকলেই একটু বোকা মনে করে। কাজেই তাহাকে আর লেবুর ঝুড়ি দিয়া রাজার বাড়ি পাঠাইতে কেহ বলিল না। কিন্তু সে যাইবার জন্য একেবারে সাজিয়া গুজিয়া প্রস্তুত হইয়া আছে। যতক্ষণ না চাষি তাহাকে যাইতে বলিল, ততক্ষণ তাহাকে কিছুতেই ছাড়িল না। শেষটা তাহাকেও এক ঝুড়িতে লেবু দিয়া পাঠাইতে হইল।

 পথে সেই একহাত লম্বা মানুষের সহিত মানিকেরও দেখা হইল। একহাত লম্বা মানুষ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ঝুড়িতে কি ও?’ মানিক বলিল, ‘ঝুড়িতে লেবু আছে তাই খেয়ে রাজার মেয়ের অসুখ সারবে।’ এক হাত লম্বা মানুষ বলিল, ‘আচ্ছা তাই হোক।’

 রাজবাড়িতে ঢুকিতে মানিকের যার পর নাই মুশকিল হইয়াছিল। অনেক মিনতি আর হাত জোড়ের পর দারোয়ানেরা তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল আর বলিল, ‘দেখিস, যেন ব্যাঙ কি ঝিঙের বীচি-টিচি হয় না। তাহলে কিন্তু তোর প্রাণটা থাকবে না।’

 যাহা হউক মনকের ঝুড়িতে লেবুই পাওয়া গেল। রাজামহাশয় ত খুবই খুশি! তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর লেবু পাঠাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘কেমন হয়, আমাকে খবর দিস্’ খবরের আশায় রাজামহাশয় বসিয়া আছেন, এমন সময় মেয়ে নিজেই খবর লইয়া উপস্থিত! সেই লেবু মুখে দিতে না দিতেই তাহার অসুখ একেবারে সারিয়া গিয়াছে।

 ইহাতে রাজামহাশয় যার পর নাই আনন্দিত হইলেন, কিন্তু তাহার পরেই ভাবিতে লাগিলেন—‘তাই ত, করিয়াছি কি। এখন যে চাষির ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিতে হয়!’ এই ভাবিয়া রাজামহাশয় স্থির করিলেন যে চাষির ছেলেকে যেমন করিয়াই হউক ফাঁকি দিতে হইবে।

 মানিকলাল ভাবিতেছে, ‘এরপরই বুঝি মেয়ে বিয়ে দিবে।’ এমন সময় রাজামহাশয় তাহাকে বলিলেন, ‘বাপু, তুমি কাজটা বেশ ভালই করিয়াছ কিন্তু রাজার মেয়ে বিবাহ করা সহজ কথা নয়। আগে, আর-একখানা কাজ করিয়া দাও, তারপর দেখা যাইবে কি হয়। জলে যেমন চলে, ডাঙায়ও তেমনি চলে, এইরূপ একখানা নৌকা আমাকে গড়িয়া না দিতে পারিলে, তোমার কোন আশাই নাই।’

 মানিক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া বিদায় হইল। তারপর বাড়ি আসিয়া সকল কথা বলিল।

 বাড়ির সকলেই মানিককে নেহাত বোকা ঠাওরাইয়া রাখিয়াছিল। সুতরাং তাহারা মনে করিল যে, মান্‌কে যখন রাজার মেয়েকে ভাল করিয়া আসিয়াছে, তখন নৌকাখানা ইচ্ছা করিলেই যে-সে তয়ের করিতে পারে।

 যদু একখানা কুড়াল লইয়া তখনই নৌকা গড়িতে চলিল। বনের ভিতর হইতে গাছ কাটিয়া সেখানেই কাজ আরম্ভ করিয়া দিল। ইচ্ছা, সেইদিনই নৌকা প্রস্তুত করিয়া ফেলে; পরিশ্রমেরও কসুর নাই। এমন সময় কোথা হইতে সেই একহাত লম্বা মানুষ আসিয়া উপস্থিত। কিহে যদুনাথ, ‘কি হচ্ছে?’ —‘গামলা।’ ‘আচ্ছ, তাই হোক।’