পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৫৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

গম্ভীর হয়ে মোটা গলায় বলল, ‘এখন দেখ্ দেখিনি? আমি বলেই ছিলাম যে ফটক নিচু, আটকাবে!’

 একটি মাসে দশটি টাকার কমে একটি স্কুলের ছেলের খাওয়া চলে না। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা চাকরকে দু’পয়সা করে দিয়েছি। তাতেই সে আমাদের দুবেলা খেতে দিয়েছে। আমি কিন্তু হিসাব-কিতাবের কথা বলতে যাচ্ছি না, আমি সেই চাকরটিব কথা বলছি! তার নাম—আমরা তার সাক্ষাতে বলতাম ‘কালী’, অসাক্ষাতে বলতাম ‘কেলে’। দুপয়সায় দুবেলা মাছ, তরকারি, ডাল, ভাত পেট ভরে খেতে দিতে হবে। কেলে তা ত দিতই, আবার তার উপরে ঢের লাভ করে নিতেও ছাড়ত না। তার লাভের চোটে আমাদের পেট চোঁ চোঁ করত।

 বাজারে যতরকমেরই মাছ উঠুক, কেলে আনে শুধু বাটা। ছ আঙুল লম্বা একটি মাছ তাকেই দু’ভাগ করে একজনকে দেয় ল্যাজা, আর-একজনকে দেয় মুড়ো। যে ল্যাজা পায়, তার তবু দুগ্রাস খাওয়া চলে, কিন্তু যে মুড়ো পায় সে বেচারার খালি চোষাই সব।

 মাছ পাতে পড়তেই ছেলেরা একজন আর-একজনকে ডেকে খবর নেয়, কার ভাগে কি জুটেছে। কিন্তু সে কথা কেউ বাংলাতে বলতে ভরসা পায় না। কেলের মেজাজটা বেজায় বেয়াড়া আর মুখটা অতি অসভ্য। ছেলেরা তাই ইংরেজিতে বলে— ‘কি হে ‘হেড’ না ‘টেইল’?’ একদিন একজনের পাতে পড়েছে ‘ল্যাজা', সে ভুলে বলে ফেলেছে ‘হেড’। অমনি কেলে বিষম দাঁত খিচিয়ে বলল, ‘কি তোমাকে দিলাম ‘টেইল’, আর তুমি যে বললে ‘হেড’?’

 সেদিন খাওয়া দাওয়ার পর ছেলেরা ঘরে এসে বলতে লাগল, ‘নাঃ, বেটাকে জব্দ করতে না পারলে আর চলছে না। ইংরাজিতে কথা বলব, তাও দুদিন শুনেই বুঝে নেবে, এ কি সহ্য হয়?’ তখন এই যুক্তি হল যে, তরকারি যতই কম হোক, সবাই মিলে কষে ভাত খেয়ে কেলেকে নাকাল করবে।

 বারজনের রান্না হয়, সেদিন রাত্রে পাঁচজনই তার সব চেঁছেপুছে খেয়ে বসে আছে আবার বলছে ‘আরো দাও’! হাঁড়ি পানে চেয়ে কেলের মুখ শুকিয়ে গেছে কিন্তু আর উপায় কি? পেট ভরে খেতে দিতেই হবে। সে বেলার কাজ শেষে দই চিঁড়ে এনে চালাতে হয়েছিল; কাজেই লাভ যা হয়েছিল, তা উলটা বাগে।

 তার পরদিনই কেলে আগে ভাগেই সাবধান হয়ে ঢের বেশি ভাত রেঁধেছিল; কিন্তু সবাই বললে, ‘আজ আমাদের খিদে নেই।’ কাজেই কেলের অনেক ভাত লোকসান হল। এমনি ভাবে দিন তিনেক যেতেই কেলে বেশ বুঝতে পারল যে ছেলেদের খুশি না রাখতে পারলে লাভের অংশ খুবই কম;তারপর থেকেই দেখা গেল যে কেলের মেজাজটিও একটু নরম, কথাবার্তাও কতকটা ভাল।