পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গল্পমালা
৪৬১

খুঁত ধরা ছেলে

 বিলাতে চারটি ভাই একদিন এক জায়গায় বসিয়া কথাবার্তা কহিতেছিল। তাহাদের আলাপের বিষয়, কে কি করিবে। সকলেরই মনে ইচ্ছা, একটা কিছু হওয়া চাই। সকলের ‘একটা কিছু’ ত আর একরকম হয় না। তাই চার ভাই চারকম কথা বলিল।

 একজন বলিল—‘আমি ইঁটের কারবার করিব। তাহাতে টাকা হইবে, আর ইঁট দিয়া আমার একখানা বাড়ি করিব।’

 আর-একজন বলিল—‘দূর হ, তোর নেহাত ছোট নজর। আমি তোর চাইতে বেশি একটা কিছু হ’ব— আমি ইঞ্জিনিয়ার হব॥ কত লোক আমার কাছে ঘরবাড়ির নক্সা করিয়া নিতে আসিবে,কত লোকের বাড়ি ঘর বাঁধিয়া দিব। আমি একটা “দশজনের একজন” হইব। বলিস্ কি, আমার নামে একটা স্ট্রীট যদি না হয়, তখন দেখিস্।’

 তৃতীয় ভ্রাতা—‘বিল্‌ডার, কণ্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার সব বাজে লোক, তোরা হ’বি চিনির বলদ। আমি কি করিব জানিস্। আমি অন্যের কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করিতে যাইব কেন। সব কাজে আমার নিজের বুদ্ধি খাটিবে। সব নূতন ফ্যাসানে বাড়ি-ঘর করিব। আমার সব এমন হইবে যাহা কেহ কখন দেখে নাই।’

 শেষ ব্যক্তি উঠিয়া বলিল—‘তোরা যাহাই করিস্ ভাই, এমন কিছু করিতে পারিবি না যাহার উপর আমার বক্তৃতা না চলিবে। উত্তম হইল, দেখ্ দেখি। তোরা যাহা করিবি, আমি তাহার দোষ ধরিব। আমার কাজের আর অভাব কি?’

 চারি ভায়ের পরামর্শ ঠিক হইল। একজন ইঁটের কাজ করিয়া কিছু টাকা করিল। ইঁট দিয়া তাহার একটি বাড়ি হইল। তা ছাড়া এক দুঃখিনী বুড়িকে ঐ ইঁট দিয়া আর একটি ঘর করিয়া দিল। কণ্ট্রাক্টর ইত্যাদি মহাশয়ও কথামত কাজ করিলেন। মিউনিসিপালিটিকে খোঁচাইয়া নিজের নামে একটি স্ট্রীট পর্যন্ত কেমন করিয়া লইয়াছেন। তিনিও একটা কিছু হইয়াছেন। তৃতীয় বেচারা নূতন ধরনে বাড়ি কবিতে গিয়া চাপা পড়িয়া মরিল। খুঁতধরা মহাশয়ের ত কথাই নাই। তাহার কাজ ফুরায়ই না। মরিবার সময় পর্যন্ত সে সন্তোষজনকরূপে, প্রশংসার সহিত কর্তব্য-কাজ করিয়া গেল।

 একদিন স্বর্গের দরজায় দারোয়ান-দেবতা বসিয়া রহিয়াছেন। সে প্রকাণ্ড দরজা। বিশ্বকর্মার হাতের তৈরি। বুঝিতেই ত পার; স্বয়ং বিশ্বকর্মা ঠাকুর যাহা করিয়াছেন সে কেমন সুন্দর। এত সুন্দর যে আর কি বলিব! দরজায় প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দুখানা কাচ লাগান। তাহার ভিতর দিয়া দারোয়ান-ঠাকুর কে আসিল দেখিতে পান। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তাহা করিতেছিলেন না। অনেক কাল হইল স্বর্গে লোক আসে না; তাই আজ-কালের ব্যস্ততা কিছু কম। দেবতা দরজা খুলিবার হীরার হ্যাণ্ডেলে হাত ঝুলাইয়া সোনার টুলে বসিয়া ঝিমাইতেছেন। এমন সময়ে কড়াৎ কড়াৎ করিয়া দরজায় ঘা মারিবার শব্দ হইল। বাহির হইতে একজন লোক বলিতেছেন—

 ‘অনুগ্রহ করুন মহাশয়, আমি ভিতরে আসিতে প্রার্থনা করিতে পারি?