পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৩১

 শকুন্তলা বলিলেন, ‘মহারাজ, আমিও তোমাকে অত্যন্ত ভালবাসি। আমি তোমার রানী হইব।’

 এ কথায় রাজা পরম আনন্দের সহিত সুন্দর সুগন্ধি সাদা ফুলের মালা আনিয়া, একগাছি নিজে পরিলেন, আর একগাছি শকুন্তলাকে পরিতে দিলেন। তারপর রাজা নিজের গলার মালা লইয়া রাজার গলায় পরাইয়া দিলেন। এইরূপে গন্ধর্বদিগের মতন করিয়া তাঁহাদের বিবাহ হইয়া গেল।

 বিবাহের খানিক পরে রাজা বলিলেন, ‘শকুন্তলা, দুদিন অপেক্ষা কর, আমি দেশে গিয়াই তোমাকে লইবার জন্য চতুরঙ্গ (অর্থাৎ, রথী, পদাতিক, অশ্বারোহী, গজারোহী, এই চারিরকমের) সেনা পাঠাইব।’

 এই বলিয়া রাজা চলিয়া গেলেন, আর শকুন্তলা, কবে তাঁহাকে নিতে রাজার লোক আসিবে, এই ভাবিয়া পথ চাহিয়া রহিলেন।

 দুষ্মন্ত চলিয়া যাওয়ার একটু পরেই কন্ব ফল লইয়া আশ্রমে ফিরিলেন। মুনি ত্রিকালজ্ঞ (অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান, সকল সময়ের কথাই জানেন), সুতরাং দুষ্মন্তের সহিত শকুন্তলার বিবাহের কথা বনে থাকিয়াই তাঁহার জানিতে বাকি ছিল না। দুষ্মন্তের মত ধার্মিক এবং গুণবান রাজা এই পৃথিবীর মধ্যে আর নাই, মুনির নিতান্ত ইচ্ছা ছিল, ঠিক এমনি একটি লোকের সহিত শকুন্তলার বিবাহ হয়। সুতরাং এই বিবাহে তাঁহার এত আনন্দ হইল যে, ঘরে ফিরিয়া ফলের বোঝাটি মাথা হইতে মাটিতে নামাইবার বিলম্বটুকুও তাঁহার সহ্য হইল না। বোঝা মাথায় করিয়াই, তিনি শকুন্তলাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ওমা, শকুন্তলা! মা, কি আনন্দের কথাই হইয়াছে? আমি সব জানিয়াছি মা। দুষ্মস্তের মতন এমন মহাশয় লোক তোমার স্বামী হওয়াতে, আমি বড়ই সুখী হইয়াছি। আমি আশীর্বাদ করি যে, তোমার পুত্র যেন সকল বীরের প্রধান, আর এই সসাগরা (অর্থাৎ সাগর সমেত) পৃথিবীর রাজা হয়।’

 মুনি যেমন বর দিলেন, শকুন্তলার তেমনি মহাবীর পুত্র হইল। ছয় বৎসর বয়সের সময় সে সিংহ, বাঘ, শুয়োর, মহিষ, আর হাতিকে আশ্রমের নিকটের গাছে বাঁধিয়া চাবুক মারিত! তাহা দেখিয়া আশ্রমের মুনিরা তাহার নাম রাখিলেন, ‘সর্বদমন’ অর্থাৎ সকলকে যে দমন (শাসন) করিতে পারে।

 কিন্তু আশ্চর্যের কথা আর কি বলিব? ‘দুদিন পরে তোমাকে লইয়া যাইব’ বলিয়া দুষ্মন্ত গেলেন, তারপর এই ছয় বৎসর চলিয়া গেল, খোকা এত বড় হইল, ইহার মধ্যে তিনি শকুন্তলার কোন সংবাদই লইলেন না।

 দুষ্মন্ত যাইবার সময়, যত দূর অবধি তাঁহাকে দেখা গিয়াছিল, শকুন্তলা কুটীরের কোণে দাঁড়াইয়া ততদূর পর্যন্ত তাঁহার পানে চাহিয়া ছিলেন। তাহার পর হইতে প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যায়, আর সকল অবসর সময়ে, সেইখানে দাঁড়াইয়া তিনি সেই পথের দিকে চাহিয়া থাকেন। প্রতিদিন তাঁহার মনে হয়, ‘আজ আমাকে নিতে আসিবে’, কিন্তু হায় প্রতিদিনই তিনি, সন্ধ্যাকাল পর্যন্ত সেই পথে কাহাকেও আসিতে না দেখিয়া, ছল ছল চোখে ঘরে ফিরেন। তাঁহার মনে এই চিস্তা ক্রমাগতই হয় যে, ‘হায়! কেন এমন হইল?’ কিন্তু পাছে কেহ দুষ্মন্তের নিন্দা করে এ জন্য নিজের মনের কথা তিনি কাহাকেও বলিলেন না।