পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৩২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 আশ্রমের সকলেই হয়ত এ কথা ভাবিয়া আশ্চর্য হইতেন, আর হয়ত দুষ্মন্তের নিন্দাও করিতেন, কিন্তু কেন যে এমন হইয়াছিল — দুষ্মস্তের মত ধার্মিক রাজা কেন যে তাঁহার রানীকে এমন আশ্চর্যভাবে ভুলিয়া গিয়াছিলেন, তাহা তাঁহাদের মধ্যে অল্প লোকেই জানিতেন, দুষ্মন্ত চলিয়া যাওয়ার পরেই একদিন দুর্বাসা মুনি কন্বের আশ্রমে আসেন, কন্ব তখন ঘরে ছিলেন না, শকুন্তলা এক মনে দুষ্মন্তের কথা ভাবিতেছিলেন, তাই তিনিও দুর্বাসাকে দেখিতে পান নাই। ইহাতেই মুনি অপমান বোধ করিয়া শকুন্তলাকে শাপ দেন, ‘যাহার কথা ভাবিয়া তুই আমাকে অমান্য করিলি সেই দুষ্মন্ত তোকে ভুলিয়া যাইবে।’ এইজন্যই হস্তিনায় গিয়া দুষ্মন্তের আর শকুন্তলার কথা মনে ছিল না।

 শকুন্তলার ছেলেটি ছয় বৎসর হইয়াছে, আর ইহারই মধ্যে সে এমন অসাধারণ বীর হইয়া উঠিয়াছে যে, ইহা দেখিয়া কন্ব শকুন্তলাকে বলিলেন, “মা, সর্বদমনের এখন যুবরাজ হওয়ার সময় হইয়াছে অতএব তোমার—আর এখানে থাকা উচিত নহে। তুমি শীঘ্র ইহাকে লইয়া হস্তিনায় চলিয়া যাও।”

 এ কথায় শকুন্তলার মনে বড়ই আনন্দ হইল। আবার কেমন একটা ভয়ও হইল। তিনি তাড়াতাড়ি যাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। তপস্বীর মেয়ের জিনিসপত্র অতি সামান্যই থাকে, সুতরাং তাহদের যাত্রার আয়োজনও খুব অল্পই করিতে হয়। কেবল একটি জিনিস ছিল, যাহাকে শকুন্তলা অন্য সকল দ্রব্যের চেয়ে ভালবাসিতেন আর যত্নে রাখিতেন। সে জিনিসটি একটি আংটি! বিবাহের সময়ে এই আংটিটি দুষ্মন্ত শকুন্তলার হাতে পরাইয়া দেন। সেই আংটিটি হাতে আছে কি না তাহাই শকুন্তলা সকলের আগে দেখিলেন; তারপর আর অন্য কিছুর জন্য তাঁহার বেশী চিন্তা হইল না।

 এইটুকু আয়োজনে আর অধিক সময় লাগিল না, তারপর কন্বের দুইজন শিষ্যকে লইয়া, আর ছেলেটিকে কোলে করিয়া শকুন্তলা হস্তিনায় যাত্রা করিলেন। কন্বের নিকট বিদায় লইবার সময়, অবশ্য তাঁহার খুব কষ্ট হইল, কিন্তু দুষ্মন্তের আর ছেলেটির কথা ভাবিয়া তিনি তাহা সহিয়া রহিলেন। পথের কষ্টকে তিনি কষ্টই মনে করিলেন না। চলিতে চলিতে তিনি এত কথা ভাবিতেছিলেন যে, পথে কি হইতেছিল, তাহার দিকে তিনি মনই দিতে পারেন নাই। কেবল খোকা খুব উৎসাহের সহিত কোন কথা বলিলে তাহাই তিনি একটু শুনিতে পাইয়া আনমনে তাহার উত্তর দিয়াছিলেন।

 এইরূপে তাঁহারা দুষ্মন্তের সভায় উপস্থিত হইলে, কন্বের শিষ্যগণ শকুন্তলাকে সেখানে রাখিয়া চলিয়া আসিলেন। কিন্তু হায়, রাজা শকুন্তলাকে দেখিয়া আনন্দিত হওয়া বা আদর করা দূরে থাকুক, তিনি তাঁহাকে চিনিতেই পারিলেন না।

 রাজার মুখের ভাব দেখিয়া মনে হইল যেন শকুন্তলাকে তিনি নিতান্ত অপরিচিত স্ত্রী লোক মনে করিয়াছেন, আর আশ্চর্য হইয়া ভাবিতেছেন, “এ কিসের জন্য এমন ভাবে আসিয়া আমার সামনে দাড়াইল?” হায়! কি লজ্জা, কি কষ্ট! রাজা চিনিতে না পারায়, শকুন্তলা নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন। তাহা শুনিয়া রাজা আরো আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “সে কি কথা? আমার ত তোমাকে কখনো দেখিয়াছি বলিয়াও মনে হয় না।”

 তখন শকুন্তলার মনে হইল, যেন সেই ঘরখানি ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। আর কোথা হইতে অন্ধকার আসিয়া সকল জিনিস ঢাকিয়া ফেলিতেছে। তারপর কি হইল, তিনি কিছুই