পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৪৩

মনে করিয়া রাজা ছেলে তিনটির নাম দম, দান্ত, আর দমন, আর মেয়েটির নাম দময়ন্তী রাখিলেন।

 এতদিনে রাজার আঁধার ঘরে আলো জ্বলিল। ছেলে তিনটির যেমন রূপ, তেমনি গুণ। আর দময়ন্তীর কথা কি বলিব? দেহের মধ্যে যেমন প্রাণ, সেই রাজপুরীর মধ্যে তেমনি হইলেন দময়ন্তী। আকাশ হইতে দেবতারা তাঁহাকে দেখিয়া বলিতেন, ‘আহ, কি সুন্দর! রাজ্যের লোক তাঁহাকে দেখিলে মনে করিত, বুঝি নিজে লক্ষ্মী রাজার ঘরে জন্ম লইয়াছেন।

 দময়ন্তী যখন বড় হইলেন, তখন শত শত সখী আর দাসী তাঁহার সেবা করিতে লাগিল। রাজবাড়ির ভিতরে মেয়েদের বেড়াইবার বাগান ছিল। সেই বাগানে দময়ন্তী তাঁহার সখীদিগকে লইয়া রোজ বেড়াইতে যাইতেন। একদিন সেখানে গিয়া তিনি দেখিলেন, এক ঝাঁক সোনার হাঁস সেখানে খেলা করিতেছে।

 হাঁস দেখিয়া দময়ন্তী বলিলেন, ‘কি সুন্দর, কি সুন্দর! ওলো, তোরা দেখিস যেন পলায় না।’

 সখীরা সকলে হাঁস ধরিতে গেল, হাঁসগুলি তাহাদিগকে লইয়া বাগানের আর-এক পানে ছুটিয়া পলাইল। একটি হাঁস পিছনে পড়িয়াছিল, দময়ন্তী নিজেই তাহাকে ধরিতে গেলেন।

 তখন হাঁস বলিল, ‘তুমি যাঁহার যোগ্য রানী, আমি তাঁহার খবর জানি। রাজকন্যা! নলের কথা শুনিয়াছ?’

 দময়ন্তী বলিলেন, ‘তুই পাখি হইয়া কথা কহিতেছিস্, না জানি, তোর খবর কেমন আশ্চর্য। তুই যাঁহার নাম করিলি, সেই নল কে? তিনি কোথায় থাকেন?

 পাখি বলিল, ‘একটা দেশ আছে, তাহার নাম নিষধ। বীরসেনের পুত্র নল সেই দেশের রাজা। রাজকন্যা! এমন রাজার কথা আর কখনো শোন নাই। এমন সুন্দর মানুষ আর কখনো দেখ নাই। দেবতা, গন্ধর্ব, মানুষ, যক্ষ, সকলকেই দেখিয়াছি রূপে গুণে নলের সমান কেহই নহে। যেমন তুমি, তেমনি নল। তুমি যদি তাঁহার রানী হও, তবেই যথার্থ সুখের কথা হয়।’

 দময়ন্তী বলিলেন, ‘হাঁস, তোর কথা বড়ই মিষ্ট। এ কথা তুই নলকে বলিতে পারিস্?’

 হাঁস বলিল, ‘অবশই পারি। আমি এই চলিলাম।’ এই বলিয়া হাঁসের ঝাঁক হাসিতে হাসিতে নলরাজার দেশে উড়িয়া গেল। নল তখন রাজবাড়ির এক কোণে বাগানের ভিতরে নিরিবিলি বসিয়া দময়ন্তীর কথাই ভাবিতেছিলেন, এ কথা হাঁসেরা জানিত। ইহার কারণ এই যে, নলের সঙ্গেই তাহাদের আগে দেখা হইয়াছিল।

 নলের বাগানে তাহারা বেড়াইতে যায়, আর, নল তাহাদের একটাকে ধরিয়া ফেলেন। হাঁসটি ধরা পড়িয়া মিনতি করিয়া বলিল, ‘মহারাজ! আমাকে মারিবেন না, আমি আপনাকে দময়ন্তীর খবর আনিয়া দিব।’

 নল ইহার আগেই দময়ন্তীর কথা শুনিয়াছিলেন, আর বাগানে বসিয়া তাঁহারই কথা ভাবিতেছিলেন। হাঁসের কথা শুনিয়া তিনি তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। তারপর তাহারা দময়ন্তীর নিকট আসিয়া তাঁহাকে ফাঁকি দিয়া নলের কথা শুনাইয়া গেল।

 সে কথা শুনিয়া অবধি আবার দময়ন্তীর চোখে ঘুম নাই, মুখে হাসি নাই। অন্ন ব্যঞ্জন থালা সুদ্ধ তাঁহার সামনে অমনি পড়িয়া থাকে। দিনরাত তিনি কেবলই নলের কথা ভাবেন, আর কাঁদেন।