পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৫২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

পায়ে যাহা চূর্ণ হয় নাই; তাহা আগুনে পুড়িয়া শেষ হইল।

 এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের ভিতরে দময়ন্তী হঠাৎ জাগিয়া উঠিয়া দেখিলেন যে সওদাগরদের মধ্যে অতি অল্প কয়েকজনই বাঁচিয়া আছে, আর তাহাদের কেহ কেহ ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া তাঁহাকেই এই বিপদের কারণ মনে করিয়াছে। তাহারা বলিতেছে, “এই পাগলিনীকে জায়গা দিয়াই আমাদের সর্বনাশ হইল। এ নিশ্চয় কোন রাক্ষসী বা পিশাচী হইবে। চল উহাকে বধ করি।”

 সেখানে আর দু-চারজন ভালো বুদ্ধিমান লোক না থাকিলে, হয়ত সেদিন দময়ন্তীর প্রাণই যাইত! ভগবানের কৃপায় সেই সকল লোক তাহার পক্ষ হওয়াতে তিনি বাঁচিয়া গেলেন।

 রাত্রি প্রভাত হইলে, সেই কয়জন সওদাগর, যাহা কিছু জিনিস অবশিষ্ট ছিল তাহাই লইয়া, অতি কষ্টে কাদিতে কাদিতে সুবাহুর দেশে যাত্রা করিল। দময়ন্তীও তাহাদের সঙ্গে চলিলেন। তাহারা যখন সুবাহুর নগরে পৌছিল, তখন সন্ধ্যা কাল। শহরের ছেলেরা তখন পথে বেড়াইতে আর খেলা করিতে বাহির হইয়াছে। দুঃখিনী দময়ন্তীর মলিন ছেড়া কাপড়, ধূলায় ধূসর শরীর আর এলো চুল দেখিয়া তাহারা মনে করিল বুঝি পাগল, তাই তাহারা হাসিতে হাসিতে আসিয়া তাহার চারিদিকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। দময়ন্তী যেদিকে যান, তাহারাও সেদিকে যায়। এমনি করিয়া তিনি রাজবাড়ীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 সেই সময়ে রাজার মা বায়ু সেবন করিবার জন্য ছাদে উঠিয়াছিলেন। সেইখান হইতে দময়ন্তীকে দেখিতে পাইয়াই, দয়ায় তাঁহার মন গলিয়া গেল। তিনি দাইকে বলিলেন, “আহা জানি কাহার বাছা গো! দুঃখিনীর মুখখানি দেখিলে প্রাণ কাঁদিয়া উঠে। যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী! ও দাই, শীঘ্র উহাকে আমার নিকট লইয়া আয়। ছেলেগুলি উহাকে বিরক্ত করিতেছে।”

 দাই তখনই ছেলের দলকে তাড়াইয়া দিয়া দময়ন্তীকে রাজমাতার নিকট লইয়া আসিল। রাজমাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা তুমি কে? তোমার স্বামীর নাম কি? আহা গায় একখানিও গহনা নাই, তবু দেখিতে কি সুন্দর! দুষ্ট ছেলের দল এত বিরক্ত করিতেছিল, তবু একটু রাগও করে নাই।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “আমি ভদ্রঘরের মেয়ে, দুঃখে পড়তে সৈরিন্ধীর কাজ করিতে প্রস্তুত হইয়াছি। আমার স্বামী পরম গুণবাণ, আর আমাকে বড়ই ভালোবাসিতেন, বিবাহের পর কয়েক বৎসর আমরা বড়ই সুখে ছিলাম, তারপর আমাদের কপাল ভাঙ্গিল। পাশায় রাজ্যধন সব হারাইয়া আমাকে লইয়া পতি বনবাসী হইলেন। এ হতভাগীর দুঃখের শেষ তাহাতেও হইল না, একদিন তিনি ঘুমের ভিতরে আমাকে ফেলিয়া কোথায় চলিয়া গেলেন, সেই অবধি পাগলিনীর মত তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি।”

 এই বলিয়া দময়ন্তী কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন, রাজমাতার চোখ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। তিনি তাহাকে বলিলেন, “বাছা, তুমি আমার নিকট থাক তোমার স্বামীর খোঁজ করাইয়া দিব। হয়ত বা ঘুরিতে ঘুরিতে তিনি নিজেই এখানে আসিয়া উপস্থিত হইতে পারেন।”

তারপর তিনি নিজের কন্যা সুনন্দাকে ডাকিয়া বলিলেন, “এই দেখ মা, তোমার জন্য কেমন সুন্দর একটি সখী পাইয়াছি। তোমরা দুজনেই এক বয়সী। এক সঙ্গে থাকিয়া তোমাদের