পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৬৩

হইলে কি করিয়া হইবে? রাজা রানী এ-সকল কথা শুনিবামাত্র বাহুককে দময়ন্তীর নিকটে ডাকাইয়া আনিলেন। বেচারা আসিয়াই ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল, কোন কথা কহিতে পারিল না।

 দময়ন্তীও প্রথমে অনেক কাঁদিলেন; তারপর তিনি একটু শান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'বাহুক, তুমি কি এমন কোন ধার্মিক পুরুষের কথা জান, যিনি নিজের স্ত্রীকে ঘুমের মধ্যে বনের ভিতরে ফেলিয়া পলায়ন করিয়াছিলেন? দেবতাগণকে ফেলিয়া আমি তাহাকে বরণ করিয়াছিলাম; আমার কোন্ অপরাধে তিনি আমাকে ফেলিয়া গেলেন?” বলিতে বলিতে তাহার চোখ জলে ভরিয়া গেল; তিনি আর কথা কহিতে পারিলেন না।

 তখন নল বলিলেন, “দময়ন্তি, আমি কলির ছলনায় পাগলের মত হইয়া যাহা করিয়াছি, তাহার জন্য আমার উপর রাগ করিও না। এখন সেই দুষ্ট আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছে কাজেই এরপর আর বোধহয় আমাদিগের দুঃখ দূর হইতে অধিক বিলম্ব নাই। আমি কেবল তোমাকে পাইবার জন্যই এখানে আসিয়াছি।”

 এরপর দুজনে অনেক কথাবার্তা হইল। তখন নলের সন্ধান করিবার জন্য দময়ন্তী যত চেষ্টা করিয়াছে, তাহার কিছুই নলের জানিতে বাকি রহিল না। দময়ন্তী দেশে বিদেশে লোক পাঠাইয়া নলকে খুঁজিয়াছেন; শেষে পর্ণাদের মুখে বাহুকের কথা শুনিয়া তিনি তাহার পরিচয় জানিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। বাহুক ঋতুপর্ণের সারথি সে যদি নল হয় তবে ঋতুপর্ণকে একদিনের ভিতরেই বিদর্ভ নগরে পৌছাইতে পারিবে। এই ভাবিয়া দময়ন্তী সুদেবকে দিয়া ঋতুপর্ণের ঋতুপর্ণের নিকট এমন সংবাদ পাঠাইলেন, যাহাতে একদিনের ভিতরেই তাহার বিদর্ভ নগরে পৌঁছাইবার দরকার হয়। ইহাতেই বাহুকের বিদর্ভ নগরে আসা হইল;নতুবা নল-দময়ীর আবার দেখা হইবার কোন উপায়ই ছিল না। এ-সকল কথার সমস্তই নল জানিতে পারিলেন; আর তাহাতে তাহার মনে বই আনন্দ হইল।

 এইরূপে তাঁহাদের দুঃখের দিন শেষ হইয়া গেল। তারপর নল সেই দুখানি কাপড় পরিয়া কর্কোটককে স্মরণ করিবামাত্র, তিনি তাহার নিজের সেই অপরূপ সুন্দর উজ্জল মূর্তি ফিরিয়া পাইলেন। তারপর সকলের মনে এমন সুখ হইল যে, তাহারা আর হাসিতে কুলাইতে না পারিয়া, ছেলেমানুষের মত কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

 এদিকে রানী রাজার নিকট ছুটিয়া গিয়া বলিতেছে, “ওগো, শীঘ্র একটি বার এস। দেখ আসিয়া, নল ফিরিয়া আসিয়াছে; আমাদের ঘরে আর আনন্দ ধরে না।”

 রাজা জোড়হাত মাথায় তুলিয়া স্বর্গের দিকে তাকাইলেন, তারপর বলিলেন, “আহা! বাঁচিয়া থাকুক, বাঁচিয়া থাকুক! আমি বুড়া মানুষ, এ সময়ে গিয়া তাহাদের সুখে বাধা দিব না। আজ তাহারা আনন্দ করুক, আর বিশ্রাম করুক, কাল গিয়া আমি তাহাদিগকে দেখিব।”

 পরদিন নল-দময়ন্তী যখন ভীমকে প্রণাম করিতে গেলেন, আর রাজ্যের সকলে এই সুখের সংবাদ জানিতে পারিল, তখন খুবই একটি আনন্দের ব্যাপার হইল—সে আর আমি কত বর্ণনা করিব! সারা দেশটার মধ্যে সকলেই হাসিমুখে ছুটাছুটি আর কোলাহল করিতেছিল; কেবল একটি লোক হাসিতে হাসিতে কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হইয়া মাথা চুলকাইতে ছিলেন।

 এ ব্যক্তি আর কেহ নহে—মহারাজ ঋতুপর্ণ। নিদ্রা হইতে উঠিয়াই তিনি শুনিতে পাইলেন