পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

যে, তাহার বাহুক নামক সারথিটিই মহারাজ নল, তিনি আবার তারা নিজ বেশ ধারণ করিয়া দময়ন্তীকে ফিরিয়া পাইয়াছে, এ কথা শুনিবামাত্র তাহার মনে হইল, “কি সর্বনাশ এত বড়লোক আমার সারথি হইয়াছিলেন, আর আমি তাহাকে চিনিতে পা্রি নাই! এমন মহাপুরুষকে দিন রাত কত আজ্ঞা করিয়াছি, আর হয়ত কতবার তাহার নিকট অপরাধীও হইয়াছি।”

 এ-সকল কথা ভাবিয়া ঋতুপর্ণের বড়ই লজ্জা হইল; আর নলকে দময়ন্তীকে ফিরিয়া পাওয়াতে, তাহার খুব আনন্দও হইল। শেষে তিনি নলকে ডাকাইয়া বলিলেন, “মহারাজ! আপনার সুখের সংবাদ শুনিয়া কত যে আনন্দিত হইলাম, তাহা মুখে প্রকাশ করিতে পারি না। আপনার নিকট না জানিয়া, হয়ত কত অপরাধ করিয়াছি। সে দোষ আমায় ক্ষমা করিতে হইবে।”

 নল বলিলেন, “সে কি মহারাজ! বিপদের সময় আমি আপনার আশ্রয়ে সুখে বাস করিতেছিলাম। আপনার আমার নিকট অপরাধ হওয়া দুরে থাকুক, বরং আমিই আপনার দয়ার ঋণ শোধ করিতে পারিব না। আপনার নিকট আমি আর এক বিষয়েও ঋণী আছি। আমি আপনাকে অশ্ববিদ্যা শিখাইব বলিয়াছিলাম, তাহা এ পর্যন্ত শিখান হয় নাই!"

 এ বলিয়া নল ঋতুপর্ণকে অশ্ববিদ্যা শিখাইয়া দিলে, ঋতুপর্ণ যার পর নাই আনন্দিত হইয়া অযোধ্যায় চলিয়া গেলেন। তারপর একটি মাস দেখিতে দেখিতে পরম সুখে কাটিয়া গেল। এক মাস পরে নল তাহার শ্বশুরকে বলিলেন, আপনার অনুমতি হইলে, এখন আমি দেশে গিয়া নিজের রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টা দেখিতে চাহি।” এ কথায় ভীম অনেক আশীর্বাদ করিয়া তাকে বিদায় দিলেন।

 এতদিন নিষধে রাজত্ব করিয়া পুষ্করের মনে হইয়াছিল যে, চিরকালই এইরূপ রাষ্ট্র করিবে। সুতরাং নল যখন তাহার নিকট গিয়া বলিলেন, পুষ্কর, আইস, আর একবার পাশা খেলি, নাহয় দুজনে যুদ্ধ করি, তখন সে ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। যাহা হউক প্রথম বারে নলকে অতি সহজেই সে হারাইয়াছিল বলিয়া সে মনে করিল যে, এবারেও তেমনি সহজে তাহাকে হারাইয়া দিবে, কাজেই সে হাসিতে হাসিতে বলিল, “তুমি বুঝি বিদেশ হইতে অনেক ধন উপার্জন করিয়া আনিয়াছ! আচ্ছা তবে আর দেরি কেন, আন পাশা! এ টাকাও শীঘ্র আমারই হউক।”

 পাশা খেলা আরম্ভ হইল। এবারে আর কলি পুষ্করের সাহায্য করিতে আসিল না। কাজেই খেলার ফল কি হইল, সহজেই বুঝা যায়। নল তাহার সমস্ত রাজ্য ধনরত্ন ফিরিয়া পাইলেনই, শেষে পুষ্কর নিজের প্রাণ পর্যন্ত পণ রাখিয়াছিলেন, তাহাও তিনি জিতিয়া লইলেন। তখন পুষ্কর জীবনের আশা ছাড়িয়া দিয়া ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে, একবাব নলের দিকে, একবার দরজার দিকে তাকাইতে আরম্ভ করিলেন, নল বলিলেন, “ভয় নাই, পুষ্কর! হাজার হউক, তুমি আমার ভাই। আর, তুমি যাহা করিয়াছ, তাহাও নিজের বুদ্ধিতে কর নাই কলিই তোমাকে দিয়া সে কাজ করাইয়াছে। সুতরাং আমি তোমাকে ক্ষমা করিতেছি, তুমি নিশ্চিন্তে ঘরে যাও। আর তোমার নিজের যে ধন আমি জিতিয়াছি, তাহাও সঙ্গে লইয়া যাও। আশীর্বাদ করি, তুমি শত বৎসর বাঁচিয়া থাকিয়া পরম সুখে কাল যাপন কর।”

 এ কথায় পুষ্কর কাঁদিতে কাঁদিতে নলের পা জড়াইয়া ধরিল। ইহার পর আর সে কখনো নলের সহিত শত্রুতা করে নাই।