পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৮১

তোমার করিতে বাধা কি?”

 উপমন্যু জোড়হাতে বলিলেন, “আপনাদের বিনয় করিয়া বলিতেছি, আমি গুরুকে না দিয়া পিষ্টক ভক্ষণ করিতে পারিব না।”

 ইহাতে অশ্বিনীকুমারেরা আহ্লাদের সহিত বলিলেন, “আমরা তোমার গুরু ভক্তি দেখিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইলাম। তোমার গুরুর দাঁত লোহার; তোমার দাঁত সোনার হইবে। আর, তোমার চক্ষু ত ভালো হইবেই; তাহা ছাড়াও তোমার অনেক মঙ্গল লাভ হইবে।”

 এ কথা শেষ হইতে না হইতেই উপমন্যু সেই অন্ধকার কুয়ার ভিতরে সকল জিনিস অতি পরিষ্কার দেখিতে লাগিলেন। ইহাতে তাঁহার মনে কিরূপ আনন্দ হইল, আর তিনি দেবতাদিগকে ভক্তিভরে প্রণামপূর্বক কত ধন্যবাদ দিলেন, তাহা বুঝিতে পার। ইহার পর আর সেই কুয়ার ভিতর হইতে উঠিয়া আসিতে তাঁহার কোন কষ্ট হইল না। তারপর উপমন্যু গুরুর নিকট আসিয়া তাঁহাকে নমস্কারপূর্বক সকল কথা বলিলে, মহর্ষির আনন্দের সীমা রহিল না। তখন তিনি উপমন্যুকে অনেক আদর দেখাইয়া, এই বলিয়া তাঁহাকে আশীর্বাদ করিলেন, “অশ্বিনীকুমারেরা যেরূপ বলিয়াছে, তোমার সেইরূপ মঙ্গল লাভ হইবে। আর, এখন হইতে বেদ আর ধর্মশাস্ত্রের কোন কথাই তোমার জানিতে বাকি থাকিবে না।”

 এমনি করিয়া আয়োদধৌম্য তাঁহার শিষ্যদিগকে পরীক্ষা করিতেন। সেকালের মুনিরা যাহাকে তাহাকে বিদা দান করিতে চাহিতেন না। তাঁহারা বেশ জানিতেন যে, যথার্থ ধার্মিক লোক হইলে, সে বিদ্যা আর ধর্মের জন্য অনেক ক্লেশ সহিতে পারে। তাই তাঁহারা অনেক সময় শিষ্যদিগকে কষ্টে ফেলিয়া দেখিতেন, সে কেমন লোক, আর তাহার বাস্তবিকই শিখিবার খুব ইচ্ছা আছে কি না। তাঁহারা যদি এত অধিক কষ্ট না দিয়া, শিষ্যদিগকে পরীক্ষা করিবার কোন উপায় বাহির করিতে পারিতেন, তবে বড়ই ভালো হইত। এত কষ্ট সহিয়া গুরুকে সন্তুষ্ট করা সাধারণ ভালো লোকের কর্ম নহে। এ কষ্ট যাঁহারা একবার পাইতেন, তাঁহারা জীবনে আর তাহা ভুলিতে পারিতেন না।


বেদ

 আয়োদধৌম্যের আর একটি শিষ্য ছিলেন। তাঁহার নাম বেদ। তাঁহাকেও মহর্ষি বিধিমতে ক্লেশ দিয়া পরীক্ষা করিয়াছিলেন। শীতে, গ্রীষ্মে, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় যতরকম কষ্ট হইতে পারে বেদের ভাগ্যে তাহার কোনটারই ত্রুটি হয় নাই। তিনি হাসিমুখে সে-সকল কষ্ট সহিয়া গুরুর সেবা করিতেন, আর মনে মনে বলিতেন, “হে ভগবন্, তোমার দয়ায় যদি আমি বিদ্যালাভ করিতে পারি, আর আমার শিষ্য জোটে, তবে আমি কখনো তাহাদিগকে এমনি করিয়া কষ্ট দিব না।”

 বাস্তবিকই বেদের যাহারা শিষ্য হইয়াছিল, তাহাদের মত সুখে খুব কম লোকেই গুরুর ঘরে বাস করিয়াছে। তিনি কখনো তাঁহার শিষ্যদিগকে নিজের সেবা বা অন্য কোন কাজ করিতে বলিতেন না। জনমেজয় ও পৌষ্যের মতন বড় বড় রাজারা তাঁহার শিষ্য হইয়া ছিলেন।