পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৬০৫

 শুকদেব পরম ভক্ত সন্ন্যাসী হইয়াই জন্মিয়াছিলেন, তাই কেহই তাহাকে পৃথিবীর ধনরত্ন কিছু উপহার দেয় নাই। ধর্মজ্ঞান এবং ভগবানের চিন্তা ভিন্ন আর কোন চিন্তাই তাহার মনে আসিত না। সুতরাং সাংসারিক সুখের আয়োজনে তাহার কি প্রয়োজন ছিল?

 দেবগণের গুরু বৃহস্পতির নিকট শুকদেব বিদ্যাশিক্ষা করিতে গেলেন; কিন্তু বৃহস্পতির তাঁহার জন্য অধিক পরিশ্রম করিতে হইল না। বেদ, বেদাঙ্গ, ইতিহাস প্রভৃতি সকল শাস্ত্র যেন আপনা হইতেই তাহার কণ্ঠস্থ হইয়া যাইতে লাগিল। অতি অল্প দিনের মধ্যেই দেখা গেল যে, তাঁহার আর কিছুই শিখিতে বাকি নাই।

 তারপর শুকদেব তপস্যা আরম্ভ করিলেন। দেবতারা এবং ঋষিগণ তাহা দেখিয়া বলিলেন, “অহো! কি আশ্চর্য তপস্যা!” শুকদেব তখনো বালক ছিলেন। কিন্তু সেই বালককে দেখিলে দেবতারাও নমস্কার করিতেন।

 কিন্তু বিদ্যা, সম্মান, তপস্যা এ-সকলের কিছুতেই শুকদেবের মন সন্তুষ্ট থাকিতে পারিল। তিনি বলিলেন, “এ সকল পাইয়া আমার কি হইবে? আমি ভগবানকে চাই আমি মুক্তি চাই।”

 তাই শুকদেব পিতার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “পিতঃ! আমি মুক্তি লাভ করিতে চাই, দয়া করিয়া আমাকে তাহার পথ বলিয়া দিন।”

 এ কথা শুনিয়া আনন্দে ব্যাসদেবের চক্ষে জল আসিল। তিনি তখন হইতেই মুক্তি লাভেব উপায়সকল শুকদেবকে শিক্ষা দিতে লাগিলেন। সে শিক্ষা সমাপ্ত হইলে তিনি বলিলেন, “বৎস এখন তুমি মিথিলার রাজা জনকের নিকট যাও, তিনি তোমাকে মুক্তির কথা বলিবেন। বিনয়ের সহিত সেই মহাপুরুষের নিকট গমন করিবে;মনের ভিতরে কোনরূপ অহঙ্কার লইয়া যাইও না। তিনি আমাদিগের যজমান, তথাপি তুমি তাঁহাকে গুকর ন্যায় মান্য করিবে।”

 শুকদেব তখনই মিথিলায় যাত্রা করিলেন। তিনি ইচ্ছা করিলেই চক্ষের পলকে শূনপথে তথায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিতেন। কিন্তু পাছে তাহাতে কিছুমাত্র অহঙ্কার প্রকাশ হয়। তাই তিনি সেরূপ না করিযা, অতিশয় শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের সহিত, পথের কষ্ট সহ্য করিয়া, তথায় হাঁটিয়া চলিলেন।

 সুমেরু হইতে মিথিলা অনেক দূরের পথ। কত নদী, কত পর্বত, কত তীর্থ, কত সবোবর, কত বন, কত প্রান্তর পার হইয়া, ইলাবৃতবর্ষ হরিবর্ষ ও কিম্পূরুষবর্ষ অতিক্রম পূর্বক তবে ভারতবর্ষে উপস্থিত হওয়া যায়। সেই ভারতবর্ষে আর্যাবর্ত, তাহার ভিতরে বিদেহ রাজ্য, সেইখানে মিথিলা নগর। মুক্তি ও ভগবানের চিন্তা করিতে, শুকদেব অনেক কষ্টে দুই প্রহর বেলায় প্রখর রৌদ্রের সময় সেই মিথিলায় উপস্থিত হইলেন।

 শুকদেব রাজপুরীর প্রথম মহলে প্রবেশ করিবামাত্র, অশিষ্ট দরোয়ান সকল আসিয়া, ভ্রুকুটি পূর্বক অতি কর্কশভাবে তাঁহার পথ আটকাইল। কিন্তু তিনি ক্ষুধা, পিপাসা এবং পথশ্রমে কাতর হইয়াও, তাহাদের কথায় কিছুমাত্র ক্রোধ না করিয়া, শান্তভাবে সেই প্রখর রৌদ্রে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন সেই দারোয়ানদিগের একজন, না জানি ইনি কোন মহাপুরুষ হইবেন, এই ভাবিয়া জোড়হাতে তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা পূর্বক, তাঁহাকে দ্বিতীয় মহলে প্রবেশ করিতে দিল। সেখানে রাজমন্ত্রী তাঁহাকে দেখিতে পাইয়াই, পরম সম্মান ও আদরের