পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬১৮
উপেন্দ্রকিশাের রচনাসমগ্র

শিখা এলাইয়া, অন্তঃপুরের দিকে ছুটিয়া চলিলেন। ততক্ষণে পিঁপড়েও চলিয়া গিয়াছে, খোকাও চুষি মুখে দিয়া যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়াছে। রাজা আসিয়া সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “তাই বল, আমি ভাবিয়াছিলাম, না জানি কি।”

 খোকাকে খানিক আদর করিয়া আবার সভায় আসিয়া রাজা বলিলেন, “হায়! একপুত্র হওয়ার কি কষ্ট! ইহার চেয়ে পুত্র না থাকাও বরং ভাল। বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্টে একটি মাত্র পুত্র পাইয়া এখন তাহার চিন্তা আমার রোগের চিন্তার চেয়েও যেন বেশি হইয়াছে। ঋত্বিক মহাশয়, এমন কি কোন কর্ম নাই, যাহা করিলে আমার একশতটি পুত্র হইতে পারে? যদি থাকে, বলুন সে কার্য নিতান্ত কঠিন হইলেও আমি তাহা করিব।”

 ঋত্বিক বলিলেন, “মহারাজ, এমন কার্য আছে আপনি যদি তাহা করিতে পারেন, তবে বলি!”

 রাজা বলিলেন, “শীঘ্র বলুন! সে কাজ ভালই হউক আর মন্দই হউক, আমি অবশ্যই তাহ করিব!”

 তখন ঋত্বিক বলিলেন, “মহারাজ! আমি আমার বাড়িতে এক যজ্ঞ করিব। সেই যজ্ঞে আপনাকে আপনার পুত্রের বসা (চবি) দ্বারা আহুতি দিতে হইবে। সেই সময় রানীগণ আহুতির ধোঁয়ার গন্ধ লইলে, তাঁহাদের সকলেরই এক-একটি পুত্র জন্মিবে। সেই সকল পুত্রের সহিত আপনার এই পুত্রটিও পুনরায় জন্মগ্রহণ করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। এ কথা যে সত্য, সেই খোকার বামপার্শ্বে একটি সোনালি চিহ্নই হইবে তাহার প্রমাণ।”

 রাজা তাহাতেই সম্মত হইলেন, সুতরাং যথাসময়ে সেই নিষ্ঠুর যজ্ঞ আরম্ভ হইল, যখন আহুতি দিবার জন্য ঋত্বিক জন্তুকে লইতে আসিলেন, রানীরা তখন তাহাকে কিছুতেই ছাড়িয়া দিতে চাহিলেন না। তাঁহাদের করুন কান্নায় পাষাণ গলিয়া যাইতে লাগিল, কিন্তু সেই নিষ্ঠুর ঋত্বিকের হৃদয় গলিল না। রানীরা খোকার ডান হাতখানি ধরিয়া রাখিয়াছিলেন, ঋত্বিক তাহার বাম হাত ধরিয়া টানাটানি করিয়া তাহাকে ছিনাইয়া আনিলেন। সেই শিশুকে হত্যা করিয়া, তাহার রসা দ্বারা আহুতি আরম্ভ হইল। সে আহুতির গন্ধ পাইয়া আর মাতাগণ তাঁহাদের শোক কিছুতেই সহ্য করিতে পারিলেন না, তাঁহারা সকলেই অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন।

 যাহা হউক, কিছুদিন পরে তাঁহাদের সকলেরই এক একটি পুত্র হইল আর তাহাদের সঙ্গে জন্তুও যে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহাতেও কোন সন্দেহ নাই। কেন না, ঋত্বিক যে সোনালি চিহ্নের কথা বলিয়াছিলেন, সেই চিহ্নটি তাহার বামপার্শে স্পষ্টই দেখা গিয়াছিল। একশত পুত্রের মধ্যে জন্তুই হইল সকলের বড়, আর সকলের চেয়ে মাতাগণের অধিক স্নেহের পাত্র।

 ইহার কিছুদিন পরে ঋত্বিকের মৃত্যু হইল, এবং যথাসময়ে মহারাজ সোমকও দেহত্যাগ করিলেন। পরলোকে গিয়া সোমক দেখিলেন যে, তাঁহার ঋত্বিককে ঘোরতর নরকে ফেলা হইয়াছে। ইহাতে তিনি নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি, ঋত্বিক মহাশয়! আপনার এমন দশা কেন হল?”

 ঋত্বিক বলিলেন, “মহারাজ। আপনার জন্য সেই যজ্ঞ করিয়াছিলাম, এখন তাহারই ফলভোগ করিতেছি।”

 তখন সোমক যমকে বলিলেন, “হে ধর্মরাজ, ইনি আমার গুরু, আর আমারই নিমিত্ত এই