পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৫০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

মহাশয়েরা কেবল আজিকার দিনটির জন্য আমার রাক্ষসেরা মানুষ খাওয়া বন্ধ করিয়াছে। সুতরাং আপনারা আপনাদের ধনরত্ন লইয়া যত শীঘ্র পারেন, প্রস্থান করুন; বিলম্ব হইলে বিপদ হইতে পারে!”

 এ কথা শুনিয়া ঠাকুর মহাশয়েরা আর তিলার্ধও তথায় অপেক্ষা করিলেন না। নিজ নিজ সম্পত্তি পুটুলি বাঁধিয়া, তাহারা সকলেই যার পর নাই ব্যস্তভাবে প্রস্থান করিলেন। গৌতম তাহার অতিশয় প্রকাণ্ড পুঁটুলিটি মাথায় করিয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে যখন সেই বটগাছের তলায় আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন প্রায় সন্ধ্যাকাল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর পরিশ্রমে, তখন আর তাহার এক পাও চলিবার শক্তি ছিল না।

 সেই গাছের তলায় পুটুলিটি রাখিয়া গৌতম বিশ্রাম করিতেছে, এমন সময় রাজধর্মও সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং তাকে ক্লান্ত দেখিয়া ব্যস্তভাবে নিজের ডানা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। তাহাতে সে একটু শান্ত হইলেই, রাজধর্ম তাড়াতাড়ি ভাল ভাল মাছ আনিয়া তাহাকে পেট ভরিয়া আহার করাইল।

 বকের সেবায় খুব আরাম পাইয়া দুষ্ট ব্রাহ্মণ ভাবিল যে, এরপর আমাকে অনেক দূর যাইতে হইবে, অর তত দূর এই প্রকাণ্ড পুঁটুলি বহিয়া নিতে খুব পরিশ্রম আর ক্ষুধাও হইবে। তখন কি খাইব?’ এই ভাবিয়া দুরাত্মা বারবার বকের দিকে তাকাইতে লাগিল, আর মনে করিল যে, এই পাখিটার গায় ঢের মাংস, আর, বোধহয় যেন তাহা খাইতে বড়ই ভাল লাগিবে। ইহাকে মারিয়া সঙ্গে লইলে আর আমার খাবারের ভাবনা থাকিবে না।

 রাজধর্ম তখন নিদ্রা যাইতেছিল। পাপিষ্ঠ ডাকাত সেই সুযোগে তাহাকে বধ করিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার পালক ছড়াইয়া আগুনে পোড়াইতে লাগিল। তারপর তাহাকে পুটুলিতে বাঁধিয়া, নিতান্ত আহ্লাদের সহিত সেখান হইতে প্রস্থান করিল।

 রাজধর্ম প্রতিদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া ব্রহ্মাকে প্রণাম করিতে যাইত্ত এবং প্রতিদিন ব্রহ্মার নিকট হইতে ফিরিবার সময় বিরূপাক্ষের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিত। ইহার পর আর সে বিরূপাক্ষের নিকট গেল না। বিরূপাক্ষ তাহাকে দেখিতে না পাইয়া, পুত্রকে ডাকিয়া বলিলেন, “আজ কেন বন্ধু রাজধর্ম আসিল না? তাহার জন্য আমার মন বড়ই ব্যাকুল হইয়াছে সেই অপদার্থ মূর্খ ব্রাহ্মণ তাহাকে বধ করে নাই ত? ঐ দুষ্টকে দেখিয়াই তাহাকে ডাকাত বলিয়া বোধ হইয়াছিল। তুমি শীঘ্র রাজধর্মের নিকট গিয়া তাহার সংবাদ জানিয়া আইস।”

 রাজপুত্র অনেক রাক্ষসের সহিত তখনই রাজধর্মের বাড়িতে গিয়া দেখিলেন যে, সে সেখানেই নাই, আর গায়ের তলায় তাহার পালকসকল পড়িয়া আছে। তাহা দেখিয়া রাক্ষসেরা চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে, তখনই ক্রোধ ভরে সেই দুষ্ট দস্যুকে ধরিবার জন্য ছুটিয়া চলিল। দুষ্ট ততক্ষণে অনেক দূর চলিয়া গিয়াছিল, কিন্তু তাই বলিয়া রাক্ষসেরা তাহাকে ধরিয়া, পুটুলি খুলিয়া যেই তাহার ভিতরে রাজধর্মের দেহ দেখিতে পাইল, অমনি চুলের মুঠি ধরিয়া, তাহাকে একেবারে বিরূপাক্ষের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল।

 বন্ধুর মৃতদেহ দেখিয়া বিরূপাক্ষের দুঃখের সীমা রহিল না। তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে মেরুব্রজ নগরের সকল লোক, সেই সরল হৃদয় সুন্দর পক্ষীটির জন্য কাঁদিয়া অস্থির হইল। তখন বিরূপাক্ষ অনেক কষ্টে চোখের জল মুছিয়া রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “এই দুরাত্মা ব্রাহ্মণকে এখনই বধ। রাক্ষসেরা ইহার মাংস ভক্ষণ করুক।”