ধ্রুবের নিকট সকল কথা শুনিয়া মুনিরা বড়ই আশ্চর্যাম্বিত হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা বাছা, এখন তুমি কি চাহ? আমরা তোমার কি সাহায্য করিতে পারি?” ধ্রুব কহিল, “আমি সেই স্থান পাইতে চাহি, যাহা অন্য কেহ পায় নাই। সে স্থান কি করিয়া পাইব আপনারা তাহা আমাকে বলিয়া দিন।” মুনিগণ বলিলেন, “যিনি সকলের বড়, যাহা কিছু আছে সকলই যাঁহার, তুমি সেই হরিকে ডাক, তাহা হইলেই তুমি সে স্থান পাইবে।”
ধ্রুব কহিল, “কি করিয়া তাঁহাকে ডাকিলে তিনি খুশি হইবেন তাহা তো আমি জানি না, তাহা আমাকে বলিয়া দিন।” মুনিরা বলিলেন, “আর কিছুরই কথা ভাবিবে না, কেবল তাঁহারই কথা ভাবিবে, আর শুধু বলিবে, ‘তুমি সকলের, তোমাকে কেহ জানিতে পারে না, তুমি সকলই জান, তোমাকে নমস্কার।’ ইহাতেই তিনি তুষ্ট হইবেন। তোমার পিতামহ মনু এইরূপেই তাঁহাকে তুষ্ট করিয়াছিলেন।”
তখন ধ্রুব সেই মুনিদিগকে প্রণাম করিয়া মনের আনন্দে সেখান হইতে যমুনার তীরে মধুবন নামক বনে গিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া সে দিনরাত একমনে এমনি ব্যাকুলভাবে হরিনাম করিতে লাগিল যে, আর কেহ কখনো তেমন করিয়া তাঁহাকে ডাকিতে পারে নাই। সেই আশ্চর্য তপস্যা দেখিয়া দেবতারা ভয় পাইলেন, পৃথিবী কাঁপিল, সাগর উছলিয়া উঠিল।
ইন্দ্র ভাবিলেন, না জানি এই বালক এমন তপস্যা করিয়া কি বিপদ ঘটাইবে। তখন তিনি আর কতগুলি দেবতার সহিত মিলিয়া ধ্রুবের তপস্যা ভাঙ্গিবার আয়োজন করিলেন। একজন দেবতা সুনীতির বেশে, ‘হায় বাছা’ ‘হায় বাছা’ বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গিয়া ধ্রুবকে বলিল, “বাবা, কত আশা করিয়া তোমাকে পাইয়াছি। দুঃখিনীর ধন, আমার যে বাছা আর কেহ নাই, আমাকে কি এমন করিয়া ফেলিয়া আসিতে হয়? তুমি যদি তপস্যা না ছাড়, তবে আমি তোমার সম্মুখেই মরিয়া যাইব।”
কিন্তু ধ্রুরের মন তখন হরির ধ্যানেই মজিয়াছিল সে সকল কপট কান্না শুনিয়াও শুনিল না। তখন সেই দুষ্ট দেবতা “বাবা গো! কি ভয়ানক রাক্ষস আসিয়াছে। পালাও পালাও,” বলিতে বলিতে সেখান হইতে চলিয়া গেল।
অমনি কোথা হইতে ভীষণ রাক্ষসগণ দলে দলে মার্-মার্ কাট-কাট শব্দে ধ্রুবকে খাইতে আসিল। সঙ্গে সঙ্গে শত শত শিয়াল ডাকিয়া উঠিল। রাক্ষসেরাও তাহাদের সিংহের মতো, উটের মতো, কুমিরের মতো মুখ দিয়া আগুন ফুঁকিতে ফুঁকিতে কতই গর্জন করিল, শেল, শূল, মুষল, মুদ্গর কতই ঘুরাইল, আর দাঁত খিচাইল! ধ্রুব তাহা টেরও পাইল না।
এইরূপে যখন ধ্রুবের তপস্যা ভাঙ্গিবার সকল চেষ্টাই বিফল হইল, তখন দেবতারা ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে শ্রীহরির নিকটে আসিয়া বলিলেন, “হে প্রভু, আমাদিগকে রক্ষা করুন। উত্তনপাদের পুত্র অতি ভীষণ তপস্যা আরম্ভ করিয়াছে, না জানি আমাদের কাহার কাজটি কাড়িয়া নিবে। শীঘ্র উহার তপস্যা থামাইয়া দিন।”
শ্রীহরি বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই। ধ্রুব কি চাহে, আমি তাহা জানি। তাহার বাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া আমি তাহার তপস্যা শেষ করিয়া দিতেছি।” তারপর তিনি সেই মধুবন আলো করিয়া ধ্রুবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “ধ্রুব! তোমার মঙ্গল হউক। আমি তোমার তপস্যায় তুষ্ট হইয়া বর দিতে আসিয়াছি; তুমি কি চাহ?” তখন ধ্রুব চক্ষু মেলিয়া