পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৭১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭১২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

সেই সাত মুনির কথা মনে পড়ল যাঁরা পার্বতীর বিয়ে ঠিক করতে এসেছিলেন। অমনি তিনি তাঁদের উপর যারপরনাই চটে বললেন, “বেটারা গেল কোথায়? আজ তাদের দাড়ি ছিঁড়তে হবে।” আবার তখনই মাথায় চাপড় মেরে বললেন, “আর তাদেরই বা দোষ কি! ঐ অভাগী মেয়েই তো যত নষ্টের গোড়া!” এই বলে তিনি পার্বতীকে কত গালই দিলেন। শেষে তিনি বললেন, “আমি কিছুতেই এই কদাকার বুড়োর কাছে মেয়ের বিয়ে দিব না। ওর না আছে টাকা, না আছে গুণ, না জানে লেখাপড়া, না পারে একটা ঘোড়া কিনে চড়তে।”

 তখন সকলে মিলে মেনকাকে কত বুঝাইলেন, কারও কথায় কিছু হল না। পার্বতী নিজে এসে একবার তাঁকে মিনতি করে দুটো কথা বলেছিলেন, তাতে তিনি দাঁত কড়্‌মড়িয়ে খেপে উঠে পার্বতীকে এমনি কিল আর কনুয়ের গুঁতো মারতে লাগলেন যে, নারদ মুনি তাড়াতাড়ি এসে তাঁকে ছড়িয়ে না নিলে সেদিন ভারি মুশকিল হত আর কি!

 যা হোক শেষে বিষ্ণু এসে অনেক উপদেশ দিতে মেনকার মন একটু শান্ত হল। ঠিক সেই সময়ে নারদও শিবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁর চেহারা অনেকটা শুধরিয়ে এনে মেনকার সামনে উপস্থিত করলেন। তখন মেনকা দেখলেন যে শিবের মাথায় জটা আর গায়ে ছাঁই বলে তাঁকে একটু উস্কোখুস্কো দেখায় বটে, কিন্তু আসলে তিনি সকল দেবতার চেয়ে সুন্দর। মেনকা যতই তাঁর মুখের দিকে তাকান, ততই তাঁর মনে হয় যে, ‘আহা কি মিষ্টি! কি সরল!’

 এমনিভাবে মেনকা অনেকক্ষণ অবাক হয়ে শিবের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “আহা! আমার পার্বতীর কপাল ভালো যে এমন স্বামী পেয়েছে!” তা শুনে শিবের ভারি লজ্জা হওয়ায় তিনি জড়সড় ভাবে দেবতার কাছে চলে গেলেন।

 এদিকে মেয়েদের মহলে ভয়ানক ছুটাছুটির ধুম লেগে গেছে। সবাই বলছে, “আরে, দেখ এসে, পার্বতীর কি সুন্দর বর হয়েছে।” তারা যে যেমন ছিল, তেমনি ভাবে, কেউ রান্না ফেলে, কেউ কলসী কাঁকে, কেউ চুল বাঁধতে বাঁধতে কেউ ঘোমটা টানতে টানতে, কেউ আছাড় খেতে খেতে এসে উপস্থিত হল। শিবকে তারা চন্দন দিয়ে, খৈ দিয়ে, আরো কতরকমে পূজো যে করল তা কি বলব! তাঁকে নিয়ে হাসি তামাশা কত হল, তার তো অন্তই নাই। মেনকা অবধি এসে তাতে যোগ না দিয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি শিবের পিছনে গিয়ে, তাঁর গলায় কাপড় জড়িয়ে টানতে আরম্ভ করেছিলেন, দেবতারা দেখে ফেলায় হাসতে হাসতে ঘরে পালিয়ে গেলেন।

 তারপর শিবকে রেশমী কাপড় পরিয়ে তাঁর গলায় সোনার ফুলের মালা, কপালে তিলক দিয়ে তাঁকে আর পার্বতীকে বিয়ের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। মুনিরা বেদ পড়তে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁদের দিয়ে বিয়ের সকল কাজ করিয়ে নিলেন। তারপর তাঁর কথায় এসে শিব আর পার্বতীর কপালে খৈ ছড়িয়ে দিতে লাগল। আর, গন্ধর্ব আর অন্সরারা মিলে গান বাজনা যে খুবই করল, তার তো কথাই নাই।

 এমনি করে শিব আর পার্বতীর বিয়ে হয়ে গেল। হিমালয় দেবতাদের সকলকে এমনি আদর অভ্যর্থনা করলেন যে তাঁদের লাজে মাথা হেঁট করে থাকতে হল। তারা হিমালয়কে কত আশীর্বাদ যে করলেন, তার লেখাজোখা নাই। তখন মেনকা লাজে জড়সড় হয়ে তাঁদের কাছে এসে বললেন, “ঠাকুর। আপনাদের কাছে আমি ভারী পাগলামি করেছি, আমার বড় অপরাধ হয়েছে, আমাকে মাপ করতে হবে।” দেবতারা হেসে বললেন, “আপনার কোনো চিন্তা নাই;