পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৭২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পুরাণের গল্প
৭২১

মুখখানি সকালবেলার সূর্যের মতো লাল আর উজ্জ্বল দেখা যাইতেছে। রাবণ ভাবিল, চুপি চুপি গিয়া বানরকে হঠাৎ জাপটিয়া ধরিতে হইবে। এই বলিয়া সে খুবই চুপি চুপি যাইতে লাগিল; সে জানে না যে, বালী ইহার আগেই তাহাকে দেখিতে পাইয়াছে। আর তাহার মনের কথাটি ঠিক বুঝিয়া লইয়া তাহারই জন্য চুপ করিয়া বসিয়া আছে—একটিবার হাতের কাছে পাইলেই তামাশাটা দেখাইয়া দিবে।

 চোখে ভ্রুকূটি, মুখে ঘামাচি, হাত দুটি বিষম ব্যগ্রভাবে বাড়ান, এমনিভাবে আসিয়া রাবণ চোরের মতো বালীর পিছনে দাঁড়াইল; ভাবিল, ‘এইবার ধরি!’ কিন্তু হায়, তাহার আগেই বালী তাহাকে ধরিয়া বগলে পুরিয়া ফেলিল। সে একটিবার পিছনবাগে তাকাইয়াও দেখে নাই, অথচ ঠিক ফড়িংটির মতো রাক্ষসের বাছাকে ধরিয়া বগলে পুরিয়াছে। রাবণের সঙ্গের রাক্ষসগুলি অবশ্য তখন বড়ই ব্যস্ত হইয়া বালীকে মারিতে গিয়াছিল, কিন্তু বালীর কয়েকটা হাত-পা নাড়া খাইয়াই তাহারা কাঁপিয়া অস্থির, যুদ্ধ আর করিবে কি?

 এদিকে রাবণ বালীর বগলে থাকিয়া প্রাণপণে তাহাকে আঁচড় কামড় দিতেছে, কিন্তু বালীর কাছে তাহা পিঁপড়ের কামড়ের মতোও ঠেকিতেছে না। বালী সেসব অগ্রাহ্য করিয়া নিজের সন্ধ্যাবন্দনায় মন দিল। দক্ষিণ সাগরের সন্ধ্যা শেষ হইলে, রাবণকে বগলে লইয়াই সে শূন্যপথে পশ্চিম সমুদ্রে গিয়া সন্ধ্যা করিতে লাগিল। তারপর উত্তর সমুদ্রে আর পূর্ব সমুদ্রেও ঠিক সেইরূপ সন্ধ্যা শেষ না করিয়া সে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরিল না। ততক্ষণে সেই বগলের চাপে আর গন্ধে আর ঘামে রাবণের কি দশা হইয়াছিল, বুঝিয়া লও।

 কিষ্কিন্ধ্যায় বালী রাবণকে বগল হইতে বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” রাবণ যাতনায় মিটিমিটি চোখে বলিল, “আমি লঙ্কার রাজা রাবণ, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিলাম। আপনি আমাকে পশুর মতো ধরিয়া এত পথ ঘুরাইয়া আনিলেন, আপনার কি আশ্চর্য ক্ষমতা! আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুতা করিব।” সুতরাং তখন দুজনে বন্ধুতা হইয়া গেল। কাজেই সাজা পাইয়াও রাবণের শিক্ষা হইল না। সে আবার ব্রহ্মাণ্ডময় খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল, কোন ছলে কাহারও সহিত যুদ্ধ করিয়া একটু বাহাদুরী লইতে পারে কি না।

 ঘুরিতে ঘুরিতে আবার একদিন নারদ মুনির সঙ্গে রাবণের দেখা হইয়াছে। রাবণ বলিল, “মুনিঠাকুর, বলুন তো, কোন দেশের লোকের গায়ে সকলের চেয়ে বেশি জোর? তাহাদের সহিত আমি যুদ্ধ করিব।” মুনি বলিলেন, “ক্ষীরোদ সমুদ্রে শ্বেতদ্বীপ নামে একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপের লোকের মতো বলবান আর ধার্মিক মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও নাই।” এ কথা শুনিবামাত্রই রাবণ শ্বেতদ্বীপের দিকে পুষ্পকরথ চালাইয়া দিল, মুনিঠাকুরও একটু চিন্তা করিয়া তামাশা দেখিবার জন্য সেইখানেই চলিয়া গেলেন।

 তারপর রাক্ষসেরা তো সিংহনাদ করিতে করিতে শ্বেতদ্বীপে গিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু সে স্থানের এমনি তেজ যে তাহারা কিছুতেই সেখানে টিকিয়া থাকিতে পারিতেছে না। হাওয়ায় পুষ্পক রথ উড়াইয়া নিল, রাক্ষসেরা সকলে ভয়ে পলায়ন করিল। কাজেই তখন আর কি করে? সে রথ আর লোকজন সব ছাড়িয়া দিয়া নিজেই গিয়া দ্বীপের ভিতরে প্রবেশ করিল।

 সেখানে কয়েকটি মেয়ে বেড়াইতেছিল। তাহারা দেখিল, দশ মাথা আর কুড়ি হাতওয়ালা

উপেন্দ্র—৯১