পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৭২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পুরাণের গল্প
৭২৩

ভয়ংকর বাণ শন্‌শন্‌ শব্দে ছুটিয়া চলিল।

 দশরথ জানেন না যে সে বাণে কি সর্বনাশ হইবে। সে শব্দ তো হাতির শব্দ নয়, ঋষির পুত্র ভোরের বেলায় কলসী হাতে ঘাট হইতে জল নিতে আসিয়াছেন, সেই কলসীতে জল পোরার ঐ শব্দ।

 অন্ধ পিতামাতা বিছানায় পড়িয়া কষ্ট পাইতেছেন; তাঁহারা একে যারপরনাই বুড়া, তাহাতে আবার নিতান্ত দুর্বল, চলিবার শক্তি নাই। পিপাসায় তাঁহাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, তাই ছেলেটি ছুটিয়া জল নিতে আসিয়াছেন, এমন সময় কোথা হইতে এই নিদারুণ বাণ আসিয়া তাহার বুকে বিঁধিল। রক্তে দেহ ভাসিয়া গেল, কলসী হাত হইতে পড়িয়া গেল।

 ঋষিপুত্র ধুলায় পড়িয়া ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে বলিলেন, “আহা! আমি তো কাহারও কোনো অনিষ্ট করি না। বনে থাকি, ফলমূল খাই আর বৃদ্ধ অন্ধ পিতামাতার সেবা করি! ওগো! আমি তোমার নিকট কি অপরাধ করিয়াছিলাম যে এমন নিষ্ঠুর সাজা আমাকে দিলে? হায় হায়! আমার পিতামাতাকে দেখিবার যে আর কেহই নাই। আমি মরিলে যে আর তাঁহারা কিছুতেই বাঁচিবেন না!’’

 ঋষিপুত্রের কথা শুনিয়া দশরথেব হাত হইতে ধনুর্বাণ পড়িয়া গেল। তিনি দুঃখে অস্থির হইয়া পাগলের মতো ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন যে সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে!

 তখন ঋষিপুত্র অতি কষ্টে তাহাকে বলিলেন, “মহারাজ! আমার কি অপরাধ ছিল? এই এক বাণে আমারও প্রাণ গেল, আমার পিতামাতারও প্রাণ গেল। আহা! মা আর বাবা পিপাসায় কাতর হইয়া পথ চাহিয়া আছেন, আমি গেলে জল খাইতে পাইবেন।”

 দুঃখে দশরথেব বুক ফাটিয়া যাইতেছে, তাঁহার কথা বলিবার শক্তি নাই। তাহা দেখিয়া সেই যাতনার মধ্যেও ঋষিপুত্রের দয়া হইল; তিনি বলিলেন, “মহারাজ! আর এখানে বিলম্ব করিবেন না। এই সরু পথে আমাদের কুটিরে যাওয়া যায়। শীঘ্র গিয়া আমার পিতাকে এই সংবাদ দিন, আর তাঁহার রাগ দূর করুন, নইলে তিনি আপনাকে ভয়ংকর শাপ দিবেন। আর এই বাণ যে আমার বুকে বিঁধিয়া রহিয়াছে, ইহার যন্ত্রণা আমি সহ্য করিতে পারিতেছি না, শীঘ্র এটাকে তুলিয়া দিন।”

 দশরথ ভাবিলেন, “হায়! আমি এখন কি করি? বাণ না তুলিলে ইঁহার যন্ত্রণা যাইবে না, কিন্তু বাণ তুলিলেই ইঁহার মৃত্যু হইবে।”

 তখন ঋষিপুত্র বলিলেন, “আপনার কোনো ভয় নাই। বাণ তুলিবার সময় যদি আমি মরিয়া যাই, তাহাতে আপনার ব্রাহ্মণবধের পাপ হইবে না। আমি ব্রাহ্মণ নহি, আমার পিতা বৈশ্য, মা শূদ্রের মেয়ে।”

 এ কথায় দশরথ ঋষিপুত্রের বুক হইতে বাণ টানিয়া বাহির করিলেন, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটির প্রাণ বাহির হইয়া গেল। তখন সেই কলসী ভরিয়া জল লইয়া দশরথ নিতান্ত দুঃখিত মনে ধীরে ধীরে কুটিরের দিকে চলিলেন। সেখানে অন্ধ মুনি আর তাঁহার অন্ধ পত্নী পিপাসায় কাতর হইয়া পুত্রের আশায় বসিয়া আছেন। দশরথেব পায়ের শব্দ শুনিয়া মুনি বলিলেন, “বাবা, এত বিলম্ব কেন হইল? তোমার জন্য তোমার মা বড় ব্যস্ত হইয়াছেন, শীঘ্র ঘরে আইস। তুমি কি রাগ করিয়াছ বাবা? আমাদের যদি কোনো দোষ হইয়া থাকে, তাহা তোমার মনে করা উচিত নয়। তুমি কথা কহিতেছ না কেন?”