পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৮৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৭০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 এ কাজে বিপদ অনেক। একে তো সেই সকল সমুদ্রই খুব ভয়ানক স্থান। এই সেই দিন দুখানি খুব ভালো জাহাজ তিমি শিকারে গিয়াছিল, সেই দুখানিই খোয়া গিয়াছে। একখানি জাহাজ বরফের পাহাড়ের চাপনে ভাঙ্গিয়া যায়, তাহার কয়েকটি মাত্র লোক অতি কষ্টে রক্ষা পাইয়াছে; আর একটি জাহাজের যে কি হইয়াছে, তাহার কোনো ঠিকানাই নাই।

 এ-সকল বিপদ তো আছেই; যতটা সম্ভব তাহার হাত এড়াইবার জন্য লোকে গ্রীষ্মকাল দেখিয়া এই কাজে বাহির হয়। কেননা গ্রীষ্মকালে বরফের ভয় কম থাকে। কিন্তু তিমির মতো এমন বিশাল একটা জন্তুকে মারিতে যাওয়ারই যে ভয়ংকর বিপদ, বরফের বিপদ তাহার চেয়ে বেশী নহে।

 তিমিকে শীতের ভিতরে বাস করিতে হয়, কাজেই তাহার গায়ে গরম একটা কিছু না থাকিলে চলে না। উহার চামড়াই হইতেছে সেই গরম জিনিস। সে চামড়ার অধিকাংশই চর্বি, তাহার ভিতর দিয়া শীত প্রবেশ করিবার সাধ্য নাই। সমুদ্রের মাংসখেকো মাছেরা সেই চামড়া খাইতে যারপরনাই ভালোবাসে; তিমি পাইলেই তাহারা দলসুদ্ধ আসিয়া মহানন্দে তাহাকে খাইতে থাকে। তখন ডুব দিয়া একেবারে সমুদ্রের তলায় চলিয়া যাওয়া ভিন্ন আর বেচারার উপায় থাকে না। ছোট-ছোট মাছের নিতান্ত গভীর জলে যাইবার সাধ্য নাই, কাজেই সেইখানে গিয়া তিমি একটু হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে।

 কিন্তু সেই গভীর জলে আবার চিরকাল বসিয়া থাকিবার জো নাই, কেননা তাহার খোরাক যে ছোট-ছোট মাছ, তাহারা থাকে উপরে। ইহা ছাড়া, যদিও অনেকে তিমিকে মাছ বলে, তথাপি সে আসলে হাতি ঘোড়ার মতো জানোয়ার। মাছের রক্তের মতো উহার রক্ত ঠাণ্ডা নহে, কিন্তু হাতি ঘোড়ার রক্তের মতো গরম। শিশুকালে সে হাতি ঘোড়ার বাচ্চার মতো মায়ের দুধ খায়, আর, সেইটাই আসল কথা, হাতি ঘোড়ার মতো তাহারও নিশ্বাস ফেলা চাই। কাজেই আর কোনো কারণে না হউক শুধু নিশ্বাস ফেলিবার জন্যই শিশুর মতো তাহাকে বারবার উপরে আসিতে হয়।

 তিমির নিশ্বাস ফেলা এক চমৎকার ব্যাপার। আমরা যেমন নাক দিয়া নিশ্বাস ফেলি, তিনি তাহা করে না; উহার শ্বাস প্রশ্বাসের ছিদ্রটি ঠিক মাথার উপরে, একটি ছোট ঢিপির আগায়। শ্বাস ফেলিবার সময় জল আর হাওয়া মিলিয়া সেই ছিদ্রের ভিতর দিয়া শোঁ শো শব্দে প্রকাণ্ড ফোয়ারা বাহির হয়, আর অমনি মাস্তুলের উপর হইতে শিকারীদের পাহারাওয়ালা “ঐ জল ফুকিতেছে।” বলিয়া চ্যাঁচায়। তখন যে খুব একটা হুলস্থূল পড়িয়া যায়, তাহা বুঝিতেছ।

 নৌকা প্রস্তুতই থাকে, আর থাকে হাজার হাজার হাত রশি বাঁধা বড়-বড় দেহাতি বল্লম। মুহূর্তের মধ্যে সেই সব-নৌকা নিঃশব্দে তীরের মতো ছুটিয়া বাহির হয়। শিকারী বল্লম হাতে নৌকার আগায় খাড়া থাকে আর সকলে প্রাণপণে দাঁড় টানে। তিমি এত বিপদের কথা কিছুই জানে না, ইহার মধ্যে বল্লমের বিষম খোঁচা লাগিয়া তাহার প্রাণ চমকাইয়া দেয়। অমনি সে সাগর তোলপাড় করিয়া সেই বল্লম সুদ্ধ ভয়ংকর বেগে তলার দিক পানে ছোটে। বল্লমের দড়ি হস্ হুস শব্দে খুলিতে থাকে। তখন যদি ক্রমাগত তাহাতে জল না ঢালা হয় তবে তাহা ভয়ানক তাতিয়া নৌকায় আগুন ধরিয়া যাইতে পারে। যদি কাহারও পা উহাতে জড়াইয়া যায়, তবে তখনি পাখানি কাটিয়া যাইবে, না হয় দড়ির টানে লোকটি চিরদিনের