পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৮৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৭৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 মাকড়সার আটটি পা। যুদ্ধের সময় সে তার চারটিতে ভর দিয়ে আর চার পা সুদ্ধ মাথাটি উচু করে ভয়ংকর মূর্তি ধরে দাঁড়ায়। তার আসল হাতিয়ার হচ্ছে তার মুখের কাছের ঐ সাঁড়াশী দুটি। চারটি পা তুলে ধরার মতলব এই যে, তা দিয়ে শক্রর চোট সামলাতে হবে। শক্র যদি তার দু-একটা ছিড়ে ফেলে, তাতেও ক্ষতি নাই, কেননা তার জায়গায় নুতন পা গজাতে বেশি দিন লাগবে না। গঙ্গা ফড়িং যুদ্ধের সময় এমনিভাবে সামনের পা উচু করে দাঁড়ায়।


দুঃখিনী

 তার নাম কি, তাতে আমার কাজ নাই। বেচারি বড়ই দুঃখিনী। বাড়ি নাই, ঘর নাই, কি খাবে তার ঠিক নাই। দয়া করে যদি খানকতক তরকারির খোসা দাও, তাই খেয়ে সে যারপরনাই খুশি হবে।

 এর আগে সে আরেকজনদের বাড়ি থাকত; তাঁরা চলে গেলে নিতান্ত জড়সড় হয়ে আমাদের দরজায় দাঁড়াল। মাথা হেট করে শুধু লেজ নাড়ছে আর এক-একবার ভয়ে ভয়ে মুখের পানে তাকাচ্ছে; জানে না রাখবে কি তাড়িয়ে দেবে। শরীরটি রোগা, মুখখানি মলিন, কিন্তু চোখদুটি দিয়ে যেন বুদ্ধি ফুটে বেরুচ্ছে। ঘরের ভিতর বসে খাচ্ছি আর সেই উঠান থেকে সে ভুরু কুঁচকিয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে, কান খাড়া কবে, তার খবর নিচ্ছে। আমার হাতপাত থেকে মুখে যাওয়া-আসা করছে, ওর মুখখানিও তার সঙ্গে সঙ্গে উঠছে নামছে।

 ওর নাকি মা আছে, সে তার খবর নেয় না। বোন আছে, সে কামড়িয়ে তাকে খোঁড়া করে দিয়েছে। তাই তাকে দাঁড় করিয়ে ছবি আঁকা ভালো মনে হল না; খোঁড়া পা দেখিয়ে বেচারাকে লজ্জা দিয়ে কি ফল?

 আমাদের এখানে এসে দুঃখিনীর তিনটি ছানা হল, দুটি খোকা, একটি খুকি। আমরা ভাবলাম, যা হোক, তবু এদের নিয়ে ওর একটু সুখে দিন যাবে। সে কি আর ওর ভাগ্যে আছে? আমাদের হঠাৎ একটু কাজ পড়ল আমরা চলে গেলাম। ভাবলাম, চাকর রইল, সে দুঃখিনী আর তার ছানাগুলোকে দেখবে। আমাদের ও বাড়িতে ঢের ভাত ফেলা যায়, দুঃখিনীর খাবার কষ্ট হবে না। কিন্তু ও বাড়িতে গিয়ে আর দুঃখিনীর খাওয়া হল না। ছানাগুলোকে খানিকের তরেও ফেলে যেতে মার প্রাণ চাইল না। কাজেই মাসখানেক প্রায় উপোস করেই তার দিন কাটাতে হল। আমরা এসে দেখি, বেচারার হাড়গুলো আর চামড়াখানি ছাড়া আর কিছুই নাই। চলতে গেলে টলতে থাকে, প্রাণটি কেবল কোনোমতে দেহে টিকে আছে ছানাগুলো আবার ততদিনে এমনি ডানপিটে হয়ে উঠেছে, দুধ খেতে গিয়ে মাকে কামড়িয়ে কামড়িয়ে ঘা করে দিয়েছে। সেই ঘায়ের যন্ত্রণায় এখন ওরা খেতে গেলেই সে খেঁকিয়ে ওঠে।

 একদিন দেখি, দুঃখিনী শুয়ে আছে ছানাগুলো তার কাছে দুধ খেতে গিয়েছে। ভাবলাম, এবারে দুঃখিনী তাদের ঠেঙাবে। কিন্তু দুঃখিনী তা না করে, উঠে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। ছানাগুলো ভাবল, বাঃ, কি মজা! তারাও তার সঙ্গে সঙ্গে ধেই ধেই করে নাচতে