পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

পাওয়া গেল না। পনেরো দিনের পর একদিন রাত্রিতে দাস-ব্যবসায়ীরা এই গ্রামে আসিয়া সকলকে আক্রমণ করিল। আত্মীয়েরা কোথায় পলাইয়া গিয়াছিলেন, মাতা এবং পুত্র বন্দী হইলেন। ইহাদিগকে পর্টুগীজদিগের ছাউনীতে লইয়া আসিল। সেখানে সপ্তাহকাল তাঁহাদের উপর বিশেষ কোনো অত্যাচার হয় নাই, কারণ পর্টুগীজেরা এদিক ওদিক মানুষ ধরিতে ব্যস্ত ছিল। সেখানেও অন্য অনেক লোকের উপরে নানারকম লোমহর্ষণ অত্যাচার হইয়াছিল। অনেক পিতা পরিবারের জন্য যুদ্ধ করিয়া বন্দুকের গুলিতে হত হইলেন, অনেক মাতা শিশুসন্তানকে লইয়া পলায়নের চেষ্টা করাতে অস্ত্রাঘাতে প্রাণ হারাইলেন।

 যখন অনেকগুলি দাস’ সংগৃহীত হইল তখন ইহাদিগকে একটা ডিপোতে লইয়া যাওয়া হইল। সেখানে চারিশতের বেশি লোককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে। এরপর ইহাদিগকে শিকল দিয়া বাধিয়া আফ্রিকার সেই ভয়ানক রৌদ্রে একশত আশি মাইল পথ লইয়া গেল, এই সময় তাহাদের যে কি নিষ্ঠুর ব্যবহার সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহ বর্ণনা করা যায় না। ছেলেগুলি চোখের সামনে থাকিলে তাহদের কষ্ট দেখিয়া পিতামাতা নিরুৎসাহ হইতে পারে, এই বলিয়া বলপূর্বক তাহাদিগকে পৃথক করিয়া দেওয়া হইল। অনেক সময় স্ত্রীলোক এবং শিশুরা আর চলিতে না পারিয়া রাস্তায় পড়িয়া যাইত, তখন চাবুক মারিয়া তাহাদিগকে উঠিতে বাধ্য করিত। চাবুকে না কুলাইতে লোহার তীক্ষ লাঠিদ্বারা খোঁচা মারিত। বহু সংখ্যক লোক এত অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া প্রাণত্যাগ করিল। আমাদের পরিচিত শিশুটির মাতা তাহার মধ্যে একজন। শিশুটি কাঁদিতে কাঁদিতে বিষম প্রহার খাইয়া প্রাণের ভয়ে চুপ করিয়া রহিল।

 এইরূপে চলিয়া শেষে সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হইল। সেখানে তাহাদিগকে লইয়া যাইবার জন্য জাহাজ প্রস্তুত। জাহাজ দেখিয়া তাহাদের মনে অধিকতর আতঙ্ক উপস্থিত হইল। তাহারা জাহাজ দেখিয়া মনে করিল যে, এটা বুঝি একটা ভয়ানক জানোয়ার, আর এটাকে খাওয়াইবার জন্য তাহাদিগকে ধরিয়া আনিয়াছে। ভয়ে হতভাগ্যেরা চীৎকার করিতে লাগিল, তাহাদিগকে বলপূর্বক জাহাজে তোলা হইল।

 জাহাজের ভিতরে আলমারিতে বই রাখিবার মতন করিয়া দাসদিগকে রাখা হইত। পরিণত বয়স্কদের জন ছয় ফুট লম্বা আর এক ফুট চার ইঞ্চি উচু স্থান আর পাশাপাশি যত লোক ধরে — বেচারাদের পাশ ফিরিবার সম্ভাবনা থাকিত না। ছেলেদের জন্য পাঁচ ফুট লম্বা এক ফুট উচু স্থান। এইরূপে তাহদের দুই মাস কাল থাকিতে হইত। সাত-আট দিন পর একদিন কেবলমাত্র এক ঘণ্টা কালের জন্য তাহাদিগকে উপরে আসিতে দেওয়া হইত। এত অত্যাচারে কয়জন বাঁচিয়া থাকিবে? তিনজনের ভিতরে দুইজন সাধারণত জাহাজেই মারা যাইত, অবশিষ্টেরাও জন্মের মত বিকলাঙ্গ হইয়া থাকিত।


দাসত্বপ্রথাঃ ২

 আমরা যাহাদের কথা বলিতেছি তাহদের উপর ঈশ্বর সদয় হইলেন। জাহাজ ছড়িবার পর এক সপ্তাহের ভিতরেই ইলেণ্ডের একখানা যুদ্ধ জাহাজ তাহদের পিছু পিছু আসিয়া দাস-ব্যবসায়ীদিগকে আত্মসমপণ করিতে বলিল। দাস-ব্যবসায়ীরা পলায়নদ্যত হইল। জাহাজ