পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
৯৪৯

উপর অনেক সময় ভয়ানক অত্যাচার হইয়া থাকে। ভয়ানক খাটুনি, অমানুষিক অত্যাচার এই সকলই এই কুলিদিগকে অনেক সময় সহ্য করিতে হয়। অল্প কয়েকজন দয়ালু লোক আছেন, যাঁহাদের বাগানে কুলিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার হয় এবং তাহারা অনেক পরিমাণে সুখে থাকে, কিন্তু এরূপ পাশব প্রকৃতির অনেক লোক আছে যাহারা কুলিদিগকে আমেরিকার দাসের ন্যায় ব্যবহার করে। ইংরাজ রাজ্যে বলপূর্বক লোককে ধরিবার সাধ্য নাই, সুতরাং কুলি সংগ্রহ করিবার জন্য ইহাদের নিযুক্ত লোকেরা, (ইহাদিগকে আড়কাঠি বলে), অন্যরকম উপায় অবলম্বন করে। তাহারা ধার্মিকের বেশে গ্রামে গ্রামে যায় এবং অল্পবুদ্ধি লোকদিগকে কম কাজ এবং বেশি বেতনের লোভ দেখাইয়া ভুলইয়া আনে। একবার ইহাদিগকে হস্তগত করিয়া আডডায় (ডিপো) আনিয়া ফেলিতে পারিলে আর সহজে নিস্তার নাই। এইরূপ করিয়া যাহারা লোক সংগ্রহ করে তাহার সম্ভবত কখনই তাহাদের উপর পরে ভালো ব্যবহার করে না। জন্‌সাউথ রাস্তায় যেরূপ কষ্ট পাইয়াছিলেন এই সকল আড়কাঠিদের হাতে কুলিরাও প্রায় সেইরূপ ক্লেশ পায়। কিছুদিন ভালো ব্যবহার করে, সম্পূর্ণরূপে হস্তগত হইলেই অন্য মূর্তি ধারণ করে। আধপেটা খাওয়া, কথায় কথায় প্রহার, অযত্নে থাকা ইত্যাদি তো আছেই, ইহার মধ্যে যাহার কোনোরূপ রোগ হয় সে বেচারার আর রক্ষা নাই। অনেকে সময় থাকিতে টের পাইয়া এই-সকল পশুর নিকট হইতে পলায়ন করে। আমাদের একটা ঝি একবার ইহাদের হাতে পড়িয়াছিল। ইহারা যে আড়কাঠি, তাহা সে প্রথমে জানিতে পারে নাই। তাহার সঙ্গে আরো দুইজন ছিল। ইহাদিগকে আড়কাঠিরা বলিয়াছিল যে ভালো ব্রাহ্মণের বাড়িতে কাজ করিতে হইবে, ছয় টাকা মাইনে আর খোরাক-পোশাক পাইবে। তাহারা সহজেই রাজি হইল এবং সেই লোকগুলির সঙ্গে একটা বাড়িতে আসিল। সেখানে তাহাদিগকে অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইল। আমাদের ঝি একটু ব্যস্ত হইল এবং শীঘ্র শীঘ্র কাজ পাইবার জন্য তাগাদা করিতে লাগিল। আড়কাঠিরা তাহাকে বুঝাইয়া বলিল যে, ‘সাহেব আসিবেন, তিনি যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করেন সব কথাতেই হাঁ বলিও, তা হইলেই তোমার কাজ হইবে৷’ ঝির তো শুনিয়া চক্ষুস্থির—‘ওমা! সে কিগো! বামুনের বাড়িতে কাজ কোত্তে এলাম, তা আবার সাহেব কেন আসবে গো?’ ঝির প্রাণে বিষম খট্‌কা বাধিল। সে আড়কাঠিদের কথা কিছু কিছু জানিত, তাহার মনে গুরুতর সন্দেহ হইল। সে কাঁদিতে লাগিল। তাহাকে খাইতে দিল, সে কিছুই খাইল না। এইরূপে বেলা শেষ হইয়া আসিল। বিকালবেলায় অনেক কথাবার্তা, তর্ক, বিতর্ক, সন্দেহ প্রবোধ ইত্যাদি চলিতে লাগিল, ইহার মধ্যে আমার ঝি—বোঁ করিয়া ছুট্! একেবারে বাড়িতে! অন্যকয়টির শেষটা কি দশা হইল সে বলিতে পারে না৷

 আড়কাঠির কথা এখন এত প্রসিদ্ধ হইয়াছে যে এখন হঠাৎ কেহ অদৃশ্য হইলেই উহাদের কথা মনে হয়। এ বিষয়ে লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার ভিতরে একটি ঘটনা হইয়াছে তাহা বলিয়া শেষ করি৷

 আমাদের একটি ভাগ্‌নে আমার দাদার বাড়িতে থাকিত। একদিন সকালে সে অদৃশ্য হইল। বারোটার সময়ও বাড়ি ফিরে নাই দেখিয়া দাদা আমাদের বাড়িতে লোক পাঠাইলেন। সকালে সে আমাদের এখানে আসিয়াছিল বটে, কিন্তু আটটার পূর্বেই চলিয়া গিয়াছিল। জোড়াসাঁকোতে তাহার জ্যেঠামহাশয় থাকেন, সেখানে লোক পাঠাইয়া জানা গেল, সে সেখানেও যায় নাই। দেখিতে দেখিতে দুইটা বাজিল, তখন সকলেই চিন্তিত হইলাম৷