পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
৯৮৩

চীৎকারের ভিতরে একটা শৃঙ্খলা আছে। সামনের একজন যেন চ্যাঁচাইয়া বলিল, ‘ওরে বাবা রে!” পিছনের একজন যেন উত্তর দিল, “কি হল রে!’ সামনের লোক বলিল, ‘ওগো মাগো।’ পিছনের লোক বলিল, “কোথায় যাব গো! মাগো বাবা গো’ বলে না আর কিছু যে বলে, তাহাও আমি জানি না, কথাগুলি নাকি বড়ই উদ্ধশ্বাসে বলে তাহাতেই এরূপ মনে হয়। উহাতে বেশ একটা ছদ আছে, তাহাতে মনে হয়, যে একসঙ্গে পা ফেলিবার সুবিধার জন্য ঐরূপ করে, কারণ এক সঙ্গে পা ফেলিয়া চলাতে সওয়ারির আরাম আছে। অনেক সময় এরূপ বুঝা যায়, যে সামনের ব্যক্তি সর্দার, সে ঐ উপায়ে চলার সম্বন্ধে উপদেশ দেয়। আসল কথাটা যে কি, তাহা উহারাই বলিতে পারে।

 এই তো গেল পালকী বেহারার কথা। তাহার পর চাকর বামুনের কথা। কিন্তু তাহা বলিবার আগে একটু সতর্ক করিয়া দেওয়া দরকার। তীর্থস্থানে সাধারণত বিস্তর অপদার্থ অলস লোক আসিয়া জড়ো হয়। বিশেষত পুরীর মতন যদি তীর্থস্থান হয়, যেখানে রান্নাবান্নার ঝঞ্ঝাট নাই, অতি অল্প পয়সার প্রসাদ কিনিয়া খাইলেই চলে। চাকর বামুনের সংবাদ লইতে গেলেই এই হতভাগারা আসিয়া উপস্থিত হয়, কাজেই ভালো লোক সেখানকার কে তাহা জানিবার উপায় থাকে না। হয় নিতান্ত বেকুব, না হয়, বেজায় পাজি, এইরূপ লোকই প্রায আমার ভাগ্যে জুটিয়াছিল।

 চাকর আসিল, তাহার দুই পায়ে দুই গোদ, সেই গোদ ভরাট করিতে যেন শরীরের অন্যান্য স্থানের মাংস খরচ হইয়া গিয়াছে। সে ব্যক্তি আসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “কি কাজ করিতে হইবে?’

 ‘এই জল তুলবি ঘর ঝাট দিবি, বাসন মাজবি, এইসব কাজ করবি।’

 ‘সওদা করিব না?’

  না। তাহার লোক আমাদের আছে।’

 ‘সওদা করিব না, ত কঁড় করিব? বলিয়া বেচারা একেবারেই নিরুৎসাহ হইয়া গেল। বলা বাহুল্য, সে ব্যক্তি আর আমাদের কাজে আসে নাই। অন্য বিষয়ে বুদ্ধি যেমনই থাক, সওদা’ অর্থাৎ বাজার করার মর্ম, সে বেশ বুঝিয়াছে। বুদ্ধির নমুনাও কিঞ্চিৎ দিতেছি।

 সেখানকার একজন পদস্থ বাঙ্গালি ভদ্রলোকের এক ওড়িয়া চাকর ছিল। সে লোক ভালো, সুতরাং তাহার বুদ্ধিটা একটু মোটা। মনে কর, যেন তাহার নাম গদাধর।

 একদিন বাবুর একটি অতিশয় পরিচিত বন্ধু দূর দেশ হইতে আসিলেন। বাবু তখন আপিসে গিয়াছে, সুতরাং গদা বলিল, বাবু নাই! বন্ধুটি একটু নিরাশ হইয়া বলিলেন, পরিবার তো আছেন? গদা বলিল, না, না, পরিবার নাই!’ বন্ধু আর কি করেন, তিনি ক্ষুন্ন মনে ফিরিয়া গেলেন। বাড়ির কী সবই শুনিয়াছেন, কিন্তু চ্যাচাইয়া তো আর কিছু বলিতে পারেন না। তিনি গদার ব্যবহারে যারপরনাই আশ্চর্য হইলেন, আর সে ভিতরে আসিলে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিরে গদা, তুই যে বলিলি পরিবার নাই?গদা নিতান্ত সরলভাবে বলিল, ‘আমি তো ভালোই করেছি, বাবু পরিবা’ নিতে এসেছিল, আমি নাই বলে বাঁচিয়ে দিয়েছি।” সে দেশে পরিবা’ বলিতে তরকারি বুঝায়। গদা মনে করিয়াছে বাবু তরকারি চায়। সে মনিবের হিতৈষী লোক, তাহার ইচ্ছা নহে যে তাহার তরকারি লোকসান হয়, সুতরাং সে আগন্তুক বাবুকে, পরিবা নাই বলিয়া বিদায় করিয়াছে!