পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
৯৮৫

শত্রুতা, একটা আরেকটাকে ক্রমাগত খুঁজিয়া বেড়ায়, আর পরস্পরের উদ্দেশ্যে আক্রোশ প্রকাশ করে, দেখা হইলেই যুদ্ধ বাধিয়া যায়। ইহাদের জ্বালায় অনেক সময় পথ চলা কঠিন হইত। অথচ মানুষের সহিত ইহাদিগকে কখনো খারাপ ব্যবহার করিতে দেখি নাই। বরং একটা একদিন আমাদের ঘরে ঢুকিয়া যেরূপ অপ্রস্তুত হইয়া গেল, তাহাতে উহাদিগকে নিতান্ত ভালোমানুষ ভিন্ন আর কিছুই বলা যায় না। আমরা অবশ্য খুবই ভয় পাইয়াছিলাম, ততোধিক কোলাহল করিয়াছিলাম। অব একটা বাখারি আনিয়া তাহার চোখের সামনে নাডিতেও ক্রটি করি নাই। এই বাখারি দেখিয়াই ভয় পাইয়া থাকুক, না হয় আমাদের বাঙ্গলা কথার অর্থ বুঝিতে না পারিয়া তাহাকে উৎকট গালি মনে করিয়া থাকুক, যে কারণেই হউক, বেচারা যেন তাহার জীবনে আর কখনো এমন সঙ্কটে পডে নাই, এইরূপ তাহার ভাব হইল। আর দরজা খুলিয়া দিবামাত্র সে উদ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 পুরীর সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু যাহারা সমুদ্র দেখেন নাই তাহারা হয়তো জিজ্ঞাসা করিবেন, সমুদ্র কেমন দেখিলে? আমিও সমুদ্রো কথা বলিবার জন্যই এতক্ষণ ধরিয়া সুযোগ খুঁজিতেছিলাম।

 সমুদ্রটা কেমন? —এব উত্তরে আমি এমন কোনো কথাই খুঁজিয়া পাইতেছি না, যাহা বলিলে যে সমুদ্র দেখে নাই, সেও মনে মনে তাহার একটা চেহারা কল্পনা করিয়া লইতে পাবে। একটি শিশু পুকুর দেখিয়া বলিয়াছিল, কত বড় চৌবাচ্ছা!” সে যাহা আগে দেখিয়াছে, দেখা যায় না, তখন তাহাকে চৌবাচ্ছা মনে কবা শিশুর পক্ষেও সম্ভব না হইতে পারে। আর চৌবাচ্চাটাকে মনে মনে বাড়াইয়া তুলিয়া তাহার কুল-কিনারা দূর করিয়া দিতে পারলেও তাহা ঠিক সমুদ্রের মতন হইবে না।

 সমুদ্র বড় তাহার আর সন্দেহ কি? কিন্তু সমুদ্রের তীরে দাড়াইয়া তাহাকে যেটুকু বড় দেখা যায, তাহা তেমন কিছু আশ্চর্যের বিষয় নহে। পদ্মা প্রভৃতি বড়-বড় নদীর এক-এক স্থান সোজাসুজি দেখিতে প্রায় এইরূপই বোধহয়। হিমালয়ে উঠিবার সময় মাঠের দৃশ্য যে দেখিয়াছে, সে ঐরুপ সমুদ্রের চাইতে বড় জিনিসই দেখিয়াছে। যত উচুতে উঠা যায়, ততই বেশি দূর অবধি দেখিতে পাওয়া যায়। পুরীর কাছে সমুদ্র আসলে সাত হাজার মাইল লম্বা হইলে কি হইবে? তাহার কুলে দাড়াইয়া পনেরো-কুড়ি মাইলের অধিক দেখা যায় না। কিন্তু দাৰ্জিলিং-এর পথে এক এক জায়গায় নীচের দিকে তাকাইলে মাঠের উপর দিয়া ষাট-সত্তর মাইল পর্যন্ত দৃষ্টি চলে।

 সমুদ্রের সম্মান কেবল তাহার মস্ত শরীরটার জন্য নহে, তাহার আরো গুণ আছে। দেশের সাধারণ লোকেরাও সমুদ্রকে একটা দেবতা বলিয়াই মনে করে। এ কথার প্রমাণ সমুদ্রের ধারে গেলেই পাওয়া যায়।

 পুরী তীর্থস্থান, সেখানে অনেক দূর হইতে যাত্রীরা আসে। এ সকল যাত্রী যে সমুদ্র দেখিবার জন্য আসে, তাহা নহে, তাহাদের উদ্দেশ্য জগন্নাথ দেখা। ভক্তিমান যাত্রীরা অনেকে রেল হইতে জগন্নাথের মন্দির দেখিবামাত্রই হাত জোড় করে, আর মন্দিরে আসিয়া জগন্নাথকে প্রণাম করিয়া তবে সে হাত নাবায়। কিন্তু জগন্নাথের ওখান হইতে বিদায় হইয়াই

উপেন্দ্র—১১৪