পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
৯৯১

মনে হইল। যাহা মুখস্থ করিয়া রাখা গিয়াছিল, এতদিনে তাহা হাতে কলমে দেখা গেল। দেখিয়া আমার মনে হইল যে, জাহাজ আসিবার সময় কেমন হয় দেখিতে হইবে। ইহার কিছুদিন পরেই একটা জাহাজ আসিল;কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা সকালবেলায় পূর্বদিক হইতে আসাতে তাহাকে ভালো করিয়া দেখিবার সুবিধা পাই নাই। সমুদ্রের সেই অংশটা তখন সূর্যের আলোকে এমনি ঝক্ঝক্ করিতেছিল যে, সেদিকে ভালো করিয়া তাকানো গেল না। যাইবার সময় সেটা আমাকে ফাঁকি দিয়া রাত্রিতে চলিয়া গেল।

 পুরীর কাছে সমুদ্র একটুও গভীর নহে, তাই জাহাজ সেখানে কুলের কাছে ভিড়িতে পায় না, প্রায় আধ মাইল দূরে থাকে। জিনিসপত্র নৌকায় করিয়া তুলিয়া দিতে হয়, সে সকল নৌকায় দড়ির গাঁথুনি। লোনা জলে লোহা দুদিনেই মরিচা ধরিয়া ভাঙ্গিয়া যায়; সুতরাং নৌকার তক্তা জুড়িতে লোহা ব্যবহার হয় না। এইসকল নৌকায় করিয়া সমস্ত দিন ধরিয়া জাহাজে চাউল বোঝাই হইয়াছিল; আর কোনো জিনিস উঠিতে দেখি নাই। জাহাজ হইতে কোনো জিনিস সেখানে নামেও নাই।

 সমুদ্রের রঙ অতি সুন্দর। তাহা যে জমকালো তাহা নহে, কিন্তু যারপরনাই কোমল এবং সুন্দর। দেখিলে নীল রঙের কোনো দামী পাথরের কথা মনে হয়। বড়-বড় ঢেউগুলির পিঠে আসমানী রঙ, কোলে সবুজ রঙ, তাহাতে সাদা ফেনাগুলি যে কি সুন্দর দেখায় তাহা কি বলিব। লম্বা-লম্বা ঢেউগুলি যখন গড়াইয়া তীরের দিকে আসিতে থাকে, তখন তাহদের নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সেই ফেনাগুলি ফুলের মালার মতন দুলিতে থাকে।

 এইরূপ রঙ প্রায় দুপুরবেলায়ই বেশি দেখা যায়। সকালে বিকালে আকাশের রঙ অন্যরূপ থাকে, তখন সমুদ্রের রঙও অন্যরূপ হয়। সেসব রঙ দেখিতে আরো সুন্দর। কিন্তু আমি যদি এখানে তাহার বর্ণনা করিতে বসি, তবে অনর্থক পুথি বাড়িয়া যাইবে, অথচ যাহা চোখে দেখিবার ব্যাপার, মুখে বকিয়া তাহার কিছুই বুঝাইতে পারিব না।

 সকালে বিকালে সকলের চাইতে দেখিবার জিনিস সূর্যোদয় আর সূর্যস্ত। বৎসরের মধ্যে কয়েকমাস পুরীতে এই দুইটিই দেখিতে পাওয়া যায়। খুব ভোরে উঠিতে হয়। তখনো সূর্য উঠে নাই, পূর্বদিকে একটু ঝিকিমিকি দেখা দিয়াছে মাত্র। সে দিকটা ক্রমেই উজ্জ্বল হইতেছে, আর মনটাও তেমনি উৎসুক হইয়া উঠিতেছে—খালি কখন উঠিবে কখন উঠিবে এই ভাব। সে যেন আর উঠিতেই চায় না! শেষে একবার চট্‌ করিয়া একটুখানি আগুনের কণার মতো দেখা দিল। তখন তাহার চেহারা আমওয়ালা চাখিতে দিবার জন্য ছুরির আগায় করিয়া যে টুকরা বাহির করে সেইরূপ। ঢেউগুলি যেন তাহকে লইয়া লুফালুফি করিতে থাকে। ক্রমে কণার মতন, পুলির মতন, গম্বুজের মতন হইয়া শেষে হাড়ির মতন হইয়া যায়। উপরের দিকটা গোল, তারপর খানিকটা একটু সরু হইয়া তলার দিকটা আবার চওড়া। শেষটা একবার বা করিয়া জল হইতে আলগা হইয়া যায়।

 সূর্যোদয়ের ন্যায় সূর্যাভও দেখিতে খুব সুন্দর। তখনকার আকাশের রঙ প্রায়ই বেশি জমকাল হয়। চন্দ্রের উদয় অস্তও এইরূপ। তবে চাদের আলো কম, সুতরাং তাহার উদয় অস্ত তেমন উজ্জ্বল হয় না।

 কিন্তু পূর্ণিমার সময় চাঁদের আলোতে সমুদ্রের এমন একটা স্নিগ্ধ সৌন্দর্য হয় যে অনেকের নিকট তাহাই সর্বাপেক্ষা সুন্দর লাগে।