পাতা:কাদম্বরী.djvu/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১২৪
কাদম্বরী।

মৃত দেহ আনিয়া রাখিল। যিনি নানা বেশভূষায় ভূষিত হইয়া হর্ষোৎফুল্ল লোচনে প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাকে এক্ষণে দীন বেশে ও দুঃখিত চিত্তে তপস্বিনীর আকার অঙ্গীকার করিতে হইল! বিকসিত কুসুম, সুগন্ধি চন্দন, সুরভি ধূপ, যাহা উপভোগের প্রধান সামগ্রী ছিল, তাহা এক্ষণে দেবার্চ্চনায় নিযুক্ত হইল। এক্ষণে নির্ঝরবারি দর্পণ, গিরিগুহা গৃহ, লতা সখী, বৃক্ষগণ রক্ষক, তরুশাখা চন্দ্রাতপ ও কেকারব তন্ত্রীঝঙ্কার হইল। দূর হইতে আগমন করাতে ও সহসা সেই দুঃসহ শোকানলে পতিত হওয়াতে কাদম্বরীর কণ্ঠ শুষ্ক হইয়াছিল; তথাপি পান ভোজন কিছুই করিলেন না। সরোবরে স্নান করিয়া পবিত্র দুকূল পরিধান করিলেন এবং প্রিয়তমের পাদদ্বয় অঙ্কে ধারণ করিয়া দিবস অতিবাহিত করিলেন। রজনী সমাগত হইল। একে বর্ষাকাল, তাহাতে অন্ধকারাবৃত রজনী। চতুর্দ্দিকে মেঘ, মূষলধারে বৃষ্টি, ক্ষণে ক্ষণে বজ্রের নির্ঘাত ও মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের দুঃসহ আলোক। খদ্যোতমালা অন্ধকারাচ্ছন্ন তরুমণ্ডলীকে আবৃত করিয়া আরও ভয়ঙ্কর করিল। গিরিনির্ঝরের পতনশব্দ, ভেকের কোলাহল ও ময়ূরের কেকারবে বন আকুল হইল। কিছুই দেখা যায় না। কিছুই কর্ণগোচর হয় না। কি ভয়ানক সময়! এ সময়ে জনপদবাসী সাহসী পুরুষের মনেও ভয়সঞ্চার হয়; কিন্ত কাদম্বরী সেই অরণ্যে প্রিয়তমের মৃতদেহ সম্মুখে রাখিয়া সেই ভয়ঙ্করী বর্ষাবিভাবরী যাপিত করিলেন।

প্রভাতে অরুণ উদিত হইলে প্রিয়তমের শরীরে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিছুমাত্র বিশ্রী হয় নাই; বরং অধিক উজ্জ্বল বোধ হইতেছে। তখন আহ্লাদিত চিত্তে মদলেখাকে কহিলেন, মদলেখে! দেখ, দেখ! প্রাণেশ্বরের শরীর যেন সজীব বোধ হইতেছে। মদলেখা নিমেষশূন্য নয়নে অনেক ক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! জীবনবিরহে এই দেহ কেবল চেষ্টাশূন্য; নতুবা সেই রূপ, সেই লাবণ্য, কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় নাই।
এই পাতার পাঠ-প্রতিষ্ঠায় অজরচন্দ্র সরকার সম্পাদিত সংস্করণের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।