পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাতায়নিকের পত্র
১৩১

অন্তরে জেনেছে সে ছিন্ন কন্থায় লজ্জা পায় না, সে রাজমুকুট ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়তে পারে।

 শক্তিতত্ত্ব থেকে সুষমাতত্ত্বে এসে পৌঁছিয়েই বুঝতে পারি, ভুল জায়গায় এতদিন এত নৈবেদ্য জুগিয়েছি। বলির পশুর রক্তে যে শক্তি ফুলে উঠল সে কেবল ফেটে মরবার জন্যেই। তার পিছনে যতই সৈন্য, যতই কামান লাগাই-না কেন, রণতরীর পরিধি যতই বৃদ্ধির দিকে নিয়ে চলি, লুঠের ভাগকে যতই বিপুল করে তুলতে থাকি, অঙ্কের জোরে মিথ্যাকে সত্য করা যাবে না, শেষকালে ঐ অতিবড়ো অঙ্কেরই চাপে নিজের বস্তার নীচে নিজে গুঁড়িয়ে মরতে হবে।

 যাজ্ঞবল্ক্য যখন জিনিসপত্র বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিয়ে এক অঙ্ক-কষার রাজ্যে মৈত্রেয়ীকে প্রতিষ্ঠিত করে বিদায় নিচ্ছিলেন তখনই মৈত্রেয়ী বলেছিলেন, যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন কুর্যাম্! বহু, বহু, বহু— সব বহুকে জুড়ে জুড়েও, অঙ্কের পর অঙ্ক যোগ করে করেও, তবু তো অমৃতে গিয়ে পৌঁছনো যায় না। শব্দকে কেবলই অত্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে এবং চড়িয়ে দিয়ে যে জিনিসটা পাওয়া যায় সেটা হল হুংকার; আর শব্দকে সুর দিয়ে, লয় দিয়ে, সংযত সম্পূর্ণতা দান করলে যে জিনিসটা পাওয়া যায় সেইটেই হল সংগীত। ঐ হুংকারটা হল শক্তি, এর পরিমাণ পাওয়া যায়; আর সংগীতটা হল অমৃত, হাতে বহরে ওকে কোথাও মাপবার জো নেই।

 এই অমৃতের ক্ষেত্রে মানুষের অহংকারের স্রোত নিজের উল্টো দিকে, উৎসর্জনের দিকে। মানুষ আপনার দিকে কেবলই সমস্তকে টানতে টানতে প্রকাণ্ডতা লাভ করে, কিন্তু আপনাকে সমস্তর দিকে উৎসর্গ করতে করতে সে সামঞ্জস্য লাভ করে। এই সামঞ্জস্যেই শাস্তি। কোনো বাহ্য ব্যবস্থাকে বিস্তীর্ণতর করার দ্বারা, শক্তিমানের সঙ্গে শক্তিমানকে জোড়া দিয়ে পুঞ্জীভূত করার দ্বারা কখনোই সেই শান্তি পাওয়া যাবে না যে শান্তি সত্যে প্রতিষ্ঠিত, যে শান্তি অলোভে, যে শান্তি সংযমে, যে শান্তি ক্ষমায়।