পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/১৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮০
কালান্তর

শূন্য রাখে। সেইজন্যে সেই শূন্যতার ক্ষোভে পূর্ণতাকে বাইরের দিক থেকে ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছা করে, সুতরাং কেবল সংখ্যাবৃদ্ধির দিকে দিনরাত ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে হয়, ‘আরো’ ‘আরো’ হাঁকতে হাঁকতে হাঁপাতে হাঁপাতে নামতার কোঠায় কোঠায় আকাঙ্ক্ষার ঘোড়দৌড় করাতে করাতে ঘূর্ণি লাগে; ভুলেই যেতে হয়, অন্য যা-কিছু পাই আনন্দ পাচ্ছি নে।

 তা হলে চরিতার্থতা কোথায়? তার উত্তর একদিন ভারতবর্ষের ঋষিরা দিয়েছেন। তারা বলেন, চরিতার্থতা পরম একের মধ্যে। গাছ থেকে আপেল পড়ে—একটা, দুটো, তিনটে, চারটে। আপেল-পড়ার অন্তবিহীন সংখ্যাগণনার মধ্যেই আপেল-পড়ার সত্যকে পাওয়া যায়, এ কথা যে বলে প্রত্যেক সংখ্যার কাছে এসে তাকে তার মন ধাক্কা দিয়ে বলবে: ততঃ কিম! তার দৌড়ও থামবে না, তার প্রশ্নের উত্তরও মিলবে না। কিন্তু অসংখ্য আপেল পড়া যেমনি একটি আকর্ষণতত্ত্বে এসে ঠেকে অমনি বুদ্ধি খুশি হয়ে বলে ওঠে, ‘বাস, হয়েছে।’

 এই তো গেল আপেল-পড়ার সত্য। মানুষের সত্যটা কোথায়? সেন্স রিপোর্টে? এক দুই তিন চার পাঁচে? মানুষের স্বরূপপ্রকাশ কি অন্তহীন সংখ্যায়? এই প্রকাশের তত্ত্বটি উপনিষৎ বলেছেন—

যস্ত সর্বাণি ভূতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ন ততাে বিজুগুপ্‌সতে।।

যিনি সর্বভূতকে আপনারই মতো দেখেন এবং আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন, তিনি প্রচ্ছন্ন থাকেন না। আপনাকে আপনাতেই যে বদ্ধ করে সে থাকে লুপ্ত; আপনাকে সকলের মধ্যে যে উপলব্ধি করে সেই হয় প্রকাশিত। মনুষ্যত্বের এই প্রকাশ ও প্রচ্ছন্নতার একটা মস্ত দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। বুদ্ধদেব মৈত্রীবুদ্ধিতে সকল মানুষকে এক দেখেছিলেন, তাঁর সেই ঐক্যতত্ত্ব চীনকে অমৃত দান করেছিল। আর, যে বণিক লোভের প্রেরণায় চীনে এল এই ঐক্যতত্ত্বকে সে মানলে না, সে অকুণ্ঠিতচিত্তে চীনকে